পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়।
ইরানে পুলিশি হেফাজতে মাসা আমিনির (২২) মৃত্যুর এক বছর পার হলো। এই সময়ে ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়েছে শাসকগোষ্ঠী। কুর্দি এই তরুণীর মৃত্যু ঘিরে ছড়িয়ে পড়া গণবিক্ষোভের ফলে দেশটি ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সবচেয়ে মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়ে।
গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর মাসা আমিনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিক্ষোভ শুরু হয়। ইরানের বাধ্যতামূলক ইসলামি পোশাকবিধি অমান্য করায় তিন দিন আগে নীতি পুলিশ তাঁকে আটক করেছিল।
মাসা আমিনির মৃত্যুর খবর মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিজ শহর সাকেজে জানাজা ও দাফন ঘিরে বিক্ষোভ হয়। একপর্যায়ে সে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্লোগান ওঠে, ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’। এটা ছিল ইরানের ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
মাসা আমিনির পরিবার বলেছিল, মাথায় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, আগে থেকে থাকা অসুস্থতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, ওই বিক্ষোভে ইরানে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ সংখ্যা তিন শতাধিক বলে জানানো হয়েছে।
এই বিক্ষোভের সম্মুখভাগে ছিলেন নারী ও তরুণেরা। তাঁরা ইসলামি রিপাবলিকের প্রতীকগুলোকে নিশানা করেন। তাঁরা সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ছবি পোড়ান। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ বলে স্লোগান দেন।
নারীদের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও নিজেদের হিজাব খুলে ও পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। নারীদের চুল ঢেকে রাখা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করে প্রণীত আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাঁরা।
বিশেষ করে জাতিগত কুর্দি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং বালুচ অধ্যুষিত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিক্ষোভের ব্যাপকতা ছিল বেশি।
শুরুতে বিক্ষোভ সামলাতে হিমশিম খায় কর্তৃপক্ষ। তবে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বলপ্রয়োগের ফলে ক্ষমতাসীন অভিজাতরা ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান আরও পোক্ত করতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে।
পুলিশি হেফাজতে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর রাস্তা থেকে নীতি পুলিশ অনেকটাই উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে আসতেই তারা আবার সক্রিয় হতে শুরু করে। চুল না ঢেকে চলাফেরা করা নারীদের চিহ্নিত করতে ও শাস্তি প্রদানে বসানো হয় নজরদারি ক্যামেরা।
অনেক ইরানিই বলছেন, হিজাব পরিধান না করা নারীর সংখ্যা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে পোশাকবিধি অমান্যকারীদের সাজা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে পার্লামেন্ট। একই সঙ্গে আইন লঙ্ঘন করলে তারকাদের পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় থাকছে।
কুর্দিস্তান হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, গতকাল শনিবার মাসা আমিনির বাবা আমজাদ আমিনিকে গ্রেপ্তার করে নিরাপত্তা বাহিনী। কিছুক্ষণ পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মেয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান না করতে তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়।
এদিকে গণবিক্ষোভের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে গত শুক্রবার ইরানের ২৫ কর্মকর্তা, তিনটি গণমাধ্যম এবং একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিক্ষোভকারীদের দমন-পীড়নে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়েছে তেহরান।