সিরিয়া–তুরস্কে ভূমিকম্প

ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রাত্রিযাপন, নিহত বেড়ে ৩৭ হাজার

তুরস্কের কাহরামানমারাসে ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়ির পাশেই আগুন জ্বালিয়ে শরীর উষ্ণ রাখার চেষ্টায় কয়েকজন
ছবি: রয়টার্স

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কমে আসায় নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দেশ দুটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জীবিত মানুষদের সাহায্য করার বিষয়টিতে এখন জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে ভূমিকম্পের আট দিন পরও গতকাল মঙ্গলবার তুরস্কে ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

এমন সময়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যখন দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। গতকাল (বাংলাদেশ সময়) রাত ১০টা পর্যন্ত তুরস্কে মারা গেছেন ৩১ হাজার ৯৭৪ জন। আর সিরিয়ায় মারা গেছেন ৫ হাজার ৮১৪ জন। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও জাতিসংঘ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিধ্বস্ত এই দুটি দেশেই তীব্র শীত পড়ছে। এ ছাড়া কোথাও পড়ছে তুষার। এর মধ্যেই হাজারো মানুষ খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। অনেকেই ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রাত্রি যাপন করছেন।

এদিকে গতকাল যাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দুই ভাই রয়েছেন। তুরস্কের কাহরামানমারাস থেকে উদ্ধার করা দুজনের মধ্যে একজনের বয়স ১৭ বছর, আরেকজনের ২১। এসব তথ্য জানিয়ে তুরস্কের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, হাতায় প্রদেশের একটি শহরের ধ্বংসস্তূপ থেকে এক নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত মানুষ উদ্ধারে অভিযান শেষ হওয়ার পথে। এখন যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের খাবার, আশ্রয় এবং শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় ফেরানোর ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয় গাজিয়ানতেপ শহরের খেলার মাঠে আশ্রয় নেওয়া হাসান সাইমৌয়ার। পরিবারের সঙ্গে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘সাধারণ মানুষ খুব ভুগছে। আমরা তাঁবু, ত্রাণের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু এখনো কিছু পাইনি।’

সাইমৌয়ারের মতো অনেকের অবস্থাই এমন। প্লাস্টিক শিট, কম্বল, কাঠবোর্ড দিয়ে নিজেরাই কোনোরকমে তাঁবু বানিয়ে খেলার মাঠে থাকছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপবিষয়ক পরিচালক হান্স হেনরি পি ক্লুজ বলেন, এখন অনেক ত্রাণ ও সাহায্য সরঞ্জাম প্রয়োজন। আর সময়ের সঙ্গে এই চাহিদা আরও বাড়ছে। তিনি বলেন, দুই দেশ মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের এখন ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।

ক্লুজ বলেন, ঠান্ডা আবহাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল, এমন মানুষেরা ঝুঁকিতে রয়েছেন।

ট্রমায় মানুষেরা

ভূমিকম্পের পর প্রথম দিকে আহত মানুষেরা হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন অনেকেই যাচ্ছেন মানসিক বৈকল্য নিয়ে। এ প্রসঙ্গে তুরস্কের ইসকেনদেরুন হাসপাতালে কর্মরত ভারতের মেজর বিনা তিওয়ারি বলেন, ভূমিকম্পের সময় যে পরিস্থিতিতে পড়েছেন এবং যা দেখেছেন, তাতে অনেকেই মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন। ফলে অনেকেই দুর্ঘটনা–পরবর্তী মানসিক বৈকল্য নিয়ে হাসপাতালে আসছেন।

অনিশ্চিতের পথে যাত্রা

তুরস্ক ও সিরিয়ায় যাঁরা ভূমিকম্পে বেঁচে গেছেন, তাঁদের অনেকেই এলাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। এমন একজন সিরিয়ার নাগরিক হামজা বেক্রি (২২)। তবে ১২ বছর ধরে তুরস্কের হাতায় প্রদেশে থাকেন তিনি। হামজা বলেন, ‘এটা খুব কঠিন যে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। আমার এখন কিছুই নেই। এমনকি চাকরিও নেই।’

হামজা জানান, তুরস্কের ইসপারতা এলাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। পরিবারও সেখানে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের অনেক আত্মীয় মারা গেছেন। আবার অনেকে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।’

তুরস্কে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫৮ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধসে যাওয়া ঘরবাড়ি ফেলে রেখে এসব এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

সিরিয়াতেও উদ্ধার তৎপরতা শেষের পথে

তুরস্কের মতো সিরিয়াতেও উদ্ধার তৎপরতা শেষের পথে। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে হোয়াইট হেলমেটস নামের একটি সংগঠন। ধসে যাওয়া ভবন থেকে মানুষ উদ্ধারে সুনাম রয়েছে সিরিয়ার এই সংগঠনের। এই সংগঠনের রায়েদ আল সালেহ বলেন, ‘আমরা এটা ইঙ্গিত পাচ্ছি, এখানে আর কেউ জীবিত নেই। তবে এরপর আমরা চূড়ান্ত পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাচ্ছি।’

দুই দেশেই উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছিল রাশিয়ার উদ্ধারকারী দল। তারাও তাদের কাজ গুটিয়ে নিচ্ছে।

এদিকে উদ্ধারকাজ যখন শেষ হয়ে আসছে, তখন ত্রাণ তৎপরতা বাড়ছে সিরিয়ায়। সেখানকার বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তুরস্ক হয়ে ত্রাণের ট্রাক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। জাতিসংঘের দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন খুলে দেওয়া সীমান্ত দিয়ে ট্রাকগুলো সেখানে প্রবেশ করছে।