এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও ১০ দেশ ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সাফ বলে দিয়েছে, তারা যদি দক্ষিণ লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে আবারও হামলা চালায়, তবে তার ‘পরিণতি ভোগ’ করতে হবে। ছয় দিনের সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে হুতিরা গত মঙ্গলবার রাতে আবার হামলা শুরু করেছে।
১৮টি ড্রোন ও ৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ১৮ মাইল প্রশস্ত বাব এল-মান্দেব প্রণালী ও এর আশপাশে যুদ্ধজাহাজের একটি বহরকে লক্ষ্যবস্তু করে ছোড়া হয়। বাব এল-মান্দেবের ওই এলাকা লোহিত সাগরে হুতিনিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনের সবচেয়ে কাছে। ব্রিটিশদের ভাষ্য, ড্রোনগুলো ছিল ইরানের নকশা করা। যদিও ওই সব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে, তবে এই ভয়াবহ হামলা পশ্চিমা রাজনীতিতে আঁচড় কেটেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাহরাইন সফরকালে গতকাল বুধবার বলেন, ‘যদি এমনটা গতকালের (মঙ্গলবারের হামলা) মতো চলতে থাকে, তাহলে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপস বলেন, ‘এই স্থান (লোহিত সাগরে হামলা) নজরে রাখুন’। সতর্কতা উচ্চারণ করে ব্রিটিশ এই মন্ত্রী বলেছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে দেওয়া যেতে পারে না।
গাজায় হামাসের সমর্থনে গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে সুয়েজ খালের দক্ষিণ অংশ দিয়ে যাতায়াত করা বাণিজ্যিক জাহাজকে লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে হুতি বিদ্রোহীরা। এ হামলা ‘আত্মপ্রচার’ হিসেবে শুরু করা হলেও পরে তা অন্য কিছুতে রূপ নিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। মার্কিন নির্বাচনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটন থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় প্রয়াসের কথা তত জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য মিত্রদের তারা পাশে নিয়ে আসছে।
মঙ্গলবার রাতের আগে মোট ৬১টি ড্রোন ছুড়ে ২৫টি হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যার আগে ১৮টি শাহেদ-১৩৬ ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি রণতরি লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল মনে করা হচ্ছে। রয়্যাল নেভির রণতরি এইচএমএস রিচমন্ড সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করে। শ্যাপস সাংবাদিকদের বলেন, এই রণতরিই হয়তো ‘সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু ছিল’।
গাজায় হামাসের সমর্থনে গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে সুয়েজ খালের দক্ষিণ অংশ দিয়ে যাতায়াত করা বাণিজ্যিক জাহাজকে লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে হুতি বিদ্রোহীরা। এ হামলা ‘আত্মপ্রচার’ হিসেবে শুরু করা হলেও পরে তা অন্য কিছুতে রূপ নিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
ঝাঁকে ঝাঁকে হামলা করার বিষয়টি ইউক্রেন থেকে নেওয়া একটি কৌশল, যেখানে স্থানীয় বিমান প্রতিরক্ষাকে জোরদার করার চেষ্টায় বেশ কয়েকটি শাহেদ ড্রোন মোতায়েন করা হয়।
একটি শাহেদ-১৩৬ তৈরি করতে খরচ হয় ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা ১৬ হাজার পাউন্ড। এইচএমএস রিচমন্ডের সি ভাইপার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য খরচ হয় এক থেকে দুই মিলিয়ন পাউন্ড।
যদিও একটি যুদ্ধজাহাজের চেয়ে মানুষের জীবন হারানোর মূল্য অনেক বেশি। তবে হুতিদের ড্রোন হামলার ঝুঁকি সম্ভাব্য আরও খারাপ পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে ওয়াশিংটন মনে করে। সে ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত।
হোয়াইট হাউসের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল অ্যালেন বলেন, ‘যদি আমরা সেখানে শুধু প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে থাকি, তাহলে শেষ পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনগুলোর মধ্যে কোনো একটি ছুটে এসে নাবিকদের প্রাণ কেড়ে নেবে।’
এর আগে গত মাসে মধ্যপ্রাচ্যের সেন্ট্রাল কমান্ডের সাবেক মার্কিন কমান্ডার জেনারেল জোসেফ ভোটেল বলেন, তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় রাডার, উপকূলীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ও ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। জেনারেল ভোটেলের ভাষায়, এগুলো ‘খুব স্পষ্ট সামরিক লক্ষ্যবস্তু’। কিন্তু এক দফায় চালানো পশ্চিমা বিমান হামলার জেরে লোহিত সাগরে (হুতিরা) হামলা বন্ধ করে দেবে—এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
অপেক্ষাকৃত সস্তা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হাতে থাকায় এবং পশ্চিমাদের নিজেদের প্রতিরোধ সক্ষমতা দেখানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে হুতিরা তাদের ‘আত্মপ্রচার’ শিগগিরই বন্ধ করবে বলে মনে হয় না।
দীর্ঘদিন ধরে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত ইয়েমেন। বছরের পর বছর এ যুদ্ধে হুতিরা ইরানের সমর্থন ও সামরিক সহায়তা পেয়ে আসছে। হুতিদের তাই বিদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করাটা খুবই সরল হয় বৈকি। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অনুমান, হুতিদের সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ২০ হাজার। গত সেপ্টেম্বরে একটি কুচকাওয়াজে তারা সংগঠিত সামরিক বাহিনীর যে নমুনা দেখিয়েছে, তাতে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তারা ভেঙে পড়েনি।
যা-ই হোক, যেকোনো সংঘাতের বিস্তৃতি ইয়েমেনের জন্য আরও বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইসরায়েল-হামাসের সংঘাত শুরুর (৭ অক্টোবরের) আগে ৯ বছরের সংঘাতের অবসান ঘটানোর কাছাকাছি পর্যায়ে ছিল শান্তি আলোচনা। অন্যদিকে পশ্চিমা মহলের একটা অংশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কেননা, যেকোনো সামরিক পদক্ষেপে ঝুঁকিতে পড়েন বেসামরিক নাগরিকেরা।
গতকাল রাতে বাহরাইনে ব্লিঙ্কেনের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে এক সপ্তাহ আগে হুতিদের উদ্দেশে দেওয়া সতর্কতার লক্ষণীয়ভাবে মিল ছিল, যদিও সেই সতর্কতা হুতিরা উপেক্ষা করেছে। বিঙ্কেনের বক্তব্য থেকে এটা মনে করার কারণ আছে, খুব শিগগির বিস্তৃত আকারে পশ্চিমারা সামরিক পদক্ষেপ নেবে, তেমন সম্ভাবনা কম।
তবে অপেক্ষাকৃত সস্তা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হাতে থাকায় এবং পশ্চিমাদের নিজেদের প্রতিরোধ সক্ষমতা দেখানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে হুতিরা তাদের ‘আত্মপ্রচার’ শিগগিরই বন্ধ করবে বলে মনে হয় না।