প্রায় অর্ধশতাব্দীজুড়ে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর। ১৯৮২ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত কখনো সাত দিন, কখনো মাসজুড়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে দুপক্ষ। কখনো হয়েছে রীতিমতো যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ, হামলা, বিস্ফোরণে রক্তও কম ঝরেনি। ৪২ বছর ধরে নানা সময়ে দুই পক্ষের উত্তেজনাকর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে। ভাষান্তর করেছেন ফাহমিদা আক্তার।
গত বছরের অক্টোবরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। দুই পক্ষই আন্তসীমান্ত হামলা চালাতে থাকে। সম্প্রতি সে উত্তেজনা চরমে রূপ নেয়। হিজবুল্লাহ নিশ্চিত করেছে, বৈরুতে আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের দাবি, গত শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাতে হিজবুল্লাহর সদর দপ্তরের ওপর চালানো হামলায় নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। শুক্রবার বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় দাহিয়েহ এলাকায় ব্যাপক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর দক্ষিণ ফ্রন্টের কমান্ডার আলী কারাকিসহ আরও কয়েকজন কমান্ডারও নিহত হয়েছেন।
এরপর গতকাল মঙ্গলবার থেকে লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ বৈরিতা প্রায় অর্ধ শতকের পুরোনো। এ সময়ের মধ্যে দুই পক্ষ বেশ কয়েকবারই লড়াইয়ে জড়িয়েছে।
১৯৮২ সালে লেবাননে হামলা চালায় ইসরায়েল। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের ওপর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) হামলার জবাবে ওই অভিযান শুরু হয়। তখন থেকে লেবাননে সাত বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে।
ইসরায়েল চেয়েছিল তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ থাকবে, এমন একটি সরকার লেবাননের ক্ষমতায় আসুক। সে আশা নিয়ে ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল দখল করে নেয় এবং তারা বৈরুতের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বৈরুতের পশ্চিমাঞ্চলে ছিল পিএলওর মূল ঘাঁটি। ইসরায়েলি বাহিনী এলাকাটি অবরুদ্ধ করে ফেলে।
একটি সমঝোতা চুক্তির পর পিএলও তিউনিসিয়াতে সরে যায়। তবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী লেবাননে থেকে যায়। তারা স্থানীয় সংগঠনগুলোকে গৃহযুদ্ধে সমর্থন জুগিয়ে যেতে থাকে। সাবরা ও শাতিলায় হত্যাকাণ্ডেও ইসরায়েলের ভূমিকা ছিল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে দুই দিনে দুই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী এবং লেবাননের বেসামরিকদের হত্যা করেছিল লেবাননের ডানপন্থী মিলিশিয়া গোষ্ঠী।
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ঠেকাতে লেবাননের কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল শিয়া মুসলিমদের সংগঠন।
হিজবুল্লাহ গঠনের চিন্তাটি এসেছিল ইরান–সমর্থিত মুসলিম নেতাদের পরিকল্পনায়। মূলত লেবানন থেকে ইসরায়েলকে বিতাড়িত করার লক্ষ্য নিয়ে হিজবুল্লাহ নামক সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। বেকা উপত্যকা ও বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার তরুণ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন নিয়ে হিজবুল্লাহ দ্রুতই লেবাননের একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত লেবাননে বিদেশি সেনাদের কয়েকটি হামলা হয়েছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে অনেক হামলার জন্য হিজবুল্লাহকে দায়ী করা হয়ে থাকে।
১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর বৈরুতের বেশ কয়েকটি ব্যারাক ভবনে বোমা হামলা হয়। ওই হামলায় তিন শতাধিক ফরাসি ও মার্কিন শান্তিরক্ষী নিহত হন।
ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী এ হামলার দায় স্বীকার করে। অনেকের বিশ্বাস, হিজবুল্লাহরই একটি অংশ এই ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী।
১৯৮৫ সালে হিজবুল্লাহর লড়াই করার ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে তারা মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একজোট হয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে লেবাননের লিতানি নদী–তীরবর্তী এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে।
লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ ঘোষণা করে ইসরায়েল। সে নিরাপত্তা অঞ্চলটির দায়িত্ব দেওয়া হয় খ্রিষ্টান আধিপত্যশীল মিলিশিয়া বাহিনী সাউথ লেবানন আর্মিকে (এসএলএ)। এটি ইসরায়েলের ছায়া বাহিনী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের দখলদারকে সমর্থন জানিয়ে গেছে তারা।
১৯৯২ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের (১৯৭৫-১৯৯২) অবসান হওয়ার পর হিজবুল্লাহ সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ১২৮ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে আটটি আসনে জয় লাভ করে তারা।
এরপর হিজবুল্লাহর আসনসংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে পার্লামেন্টে ৬২টি আসন হিজবুল্লাহ ও তাদের মিত্রদের দখলে।
নিজেদের অবস্থান শক্ত—এমন এলাকাগুলোতে বিভিন্ন রকমের সামাজিক কর্মসূচি পরিচালনা করে হিজবুল্লাহ। এতেও তাদের প্রভাব বাড়ছে।
১৯৯৩ সালের জুলাইয়ে লেবাননে হামলা করে ইসরায়েল। তারা এর নাম দেয় ‘অপারেশন অ্যাকাউন্টেবিলিটি।’ লেবাননে একটি শরণার্থীশিবির ও গ্রামে ইসরায়েলি হামলার জবাবে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে পাল্টা হামলা চালানোর পর ওই অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই সংঘাত সাত দিন স্থায়ী হয়েছিল।
ওই সংঘাতে লেবাননের ১১৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০০ জনের বেশি। সংঘাত চলাকালে হাজারো ভবন ধ্বংস হয়েছে।
তিন বছর পর ১৯৯৬ সালের ১১ এপ্রিল ইসরায়েল আবারও লেবাননে হামলা শুরু করে। এই অভিযান ১৭ দিন স্থায়ী হয়েছিল। অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল হিজবুল্লাহকে লিতানি নদীর ওপারে হটানো। ইসরায়েল চেয়েছিল হিজবুল্লাহকে হটিয়ে এমন দূরবর্তী অবস্থানে নিয়ে যেতে, যেন হিজবুল্লাহ আর ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে না পারে।
ইসরায়েলের ওই অভিযানকে লেবাননের নাগরিকেরা এপ্রিল অ্যাগ্রেসন (এপ্রিল হামলা) নাম দিয়েছিলেন। আর ইসরায়েলিরা একে ডাকতেন ‘অপারেশন গ্রেপস অব র্যাথ’ বলে। মার্কিন লেখক জন স্টেইনবেকের ১৯৩৯ সালের উপন্যাস দ্য গ্রেপস অব র্যাথ-এর নামানুসারে এ নামকরণ করা হয়েছিল।
সামরিক ও বেসামরিকভাবে দুই পক্ষেরই উল্লেখজনক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং লেবাননের অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৮ এপ্রিল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে কানা গ্রামের কাছে জাতিসংঘ চত্বরে গোলা হামলা চালায় ইসরায়েল। প্রায় ৮০০ বাস্তুচ্যুত বেসামরিক নাগরিক সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
হামলায় কমপক্ষে ৩৭ শিশুসহ ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১১৬ জন। ফিজির চার সেনাসদস্যও তখন গুরুতর আহত হন। তাঁরা জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন।
২০০৬ সালে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হিজবুল্লাহর অভিযানে তিন ইসরায়েলি সেনা নিহত হন। আরও দুই ইসরায়েলি সেনাকে আটকে রাখে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি সেনাদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে সে দেশে কারাবন্দী থাকা লেবাননের নাগরিকদের মুক্তি দাবি করেছিল হিজবুল্লাহ।
পরে একই মাসে জুলাই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ওই যুদ্ধ ৩৪ দিন স্থায়ী হয়েছিল। লেবাননের প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ মারা যান এবং ৪ হাজার ৪০০ জন আহত হন। এর বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। ইসরায়েলও তাদের ১৫৮ জন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছিল। তাদের বেশির ভাগই সেনাসদস্য।
ইসরায়েলের প্রতি বিরোধিতা ও ইরানকে সমর্থন—এ নীতিতে চলতে থাকে হিজবুল্লাহ। এর মধ্যে ২০০৯ সালে হিজবুল্লাহ তাদের ইশতেহার হালনাগাদ করে। তারা নিজেদের এমন একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় একীভূত করার প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নয় বরং জাতীয় ঐক্য প্রতিফলিত হবে। ১৯৮৫ সালে লেখা খোলা চিঠির পর এটি ছিল হিজবুল্লাহর দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র। ১৯৮৫ সালের খোলা চিঠিতে তারা সরাসরি দেশের লক্ষ্যগুলোর বিরোধিতা করেছিল।
২০০৯ সালের ইশতেহারে হিজবুল্লাহ তাদের ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। এতে হিজবুল্লাহ কীভাবে লেবাননের সব স্তরে পরিণত হচ্ছে, তা দেখিয়েছে তারা।
২০১২ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে দেশটির সরকারকে সমর্থন জানায় হিজবুল্লাহ। তারা ওই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের এমন পদক্ষেপকে আরব সমর্থকদের অনেকে ভালোভাবে নেননি। এমনকি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সুভি আল তুফায়লিও এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছিলেন।
অবশ্য হিজবুল্লাহর সমর্থকেরা দাবি করেছিলেন, এই পদক্ষেপ লেবাননে সশস্ত্র গোষ্ঠী বিশেষ করে আইএসের মতো সংগঠনগুলোর আগ্রাসন রোধে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি এই পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধক্ষেত্র বিষয়ে বড় ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে হিজবুল্লাহ।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা শুরু করে হিজবুল্লাহ।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। প্রায় আড়াই শ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার পরপরই গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
লেবানন ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে হিজবুল্লাহ ও হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা নিহত হন।
২০২৪ সালের ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলার ভবনে হামলার ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়। দুই সপ্তাহ পর ইরান যখন ইসরায়েলকে পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে, তখন তেহরানকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জুগিয়ে গেছে হিজবুল্লাহ।
গত ২৮ জুলাই ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে একটি ফুটবল মাঠে হামলায় ১২ সিরীয় শিশু ও তরুণ নিহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ—দুই পক্ষই দাবি করে এ ঘটনায় তারা জড়িত নয়। এর কয়েক দিন পর বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর কমান্ডার ফুয়াদ শোকর হত্যার শিকার হন। তখন এ হত্যাকাণ্ডকে গোলানে ফুটবল মাঠের ঘটনার পরিণতি বলে উল্লেখ করে ইসরায়েল।
ফুয়াদ শোকর নিহত হওয়ার পরপরই হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েও নিহত হন। এই দুই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা তৈরি হয়।
ফুয়াদ শোকরের হত্যার বদলা হিসেবে আগস্টের শেষের দিকে রকেট হামলা চালায় হিজবুল্লাহ।
২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত কয়েক হাজার পেজার যোগাযোগযন্ত্রে বিস্ফোরণ হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিশোধের হুমকি দেয় তারা। মূলত ১৭ সেপ্টেম্বর এই পেজার বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। গত সপ্তাহ থেকে রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে জোরালো হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। লেবানন সরকারের হিসাব অনুসারে, গত কয়েক দিনের হামলায় দেশটিতে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।