গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। ইরানের রাজধানী তেহরানে এসেছিলেন কুর্দি তরুণী মাসা আমিনি (২২)। কিন্তু ইরানের ‘নিয়ম’ মেনে তিনি হিজাব না পরায় দেশটির ‘নীতি পুলিশ’ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তিন দিন পর পুলিশের হেফাজতেই তাঁর মৃত্যু হয়। মাসার মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশটির মানুষ। দেশজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। বিক্ষোভ এখনো চলছে। বিক্ষোভ দমনের সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে ইরানের সরকার। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী এখন কারাগারে। এর মধ্যে অনেকের সাজা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড হয়েছে অনেকের। কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও হয়েছে।
ইরানে দমনপীড়নের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। চার বছর আগে একটি চিনিকলের শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি জানানোয় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেপিদেহ কোলিয়ানকে। সেই মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত কোলিয়ান এখনো কারাগারে বন্দী। ইরানের নারী অধিকারকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ তিনি। কারাগার থেকে তিনি একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে কোলিয়ান বর্ণনা করেছেন, কীভাবে বন্দীদের কাছ থেকে জোর করে বিভিন্ন অভিযোগের দায় স্বীকারের জবানবন্দি নিচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। পরে এসব ব্যক্তিকে বিভিন্ন সাজা, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হচ্ছে।
কোলিয়ান বর্তমানে এভিন কারাগারে আছেন। ইরানের রাজধানী তেহরানের অদূরের এই কারাগার নিয়ে পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমালোচনা করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ, এভিন কারাগারের কর্তৃপক্ষ সেখানে থাকা বন্দীদের নির্যাতন ও অনির্দিষ্টকাল কারাগারে আটক রাখার হুমকি দেন। বন্দীদের দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে দায় স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়। বন্দীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না।
ওই কারাগারে থাকা কোলিয়ানের লেখা চিঠিতেও বন্দীদের নির্যাতন, অত্যাচার ও জোর করে অপরাধের দায় স্বীকার করিয়ে নেওয়ার বিবরণ আছে। কোলিয়ান তাঁর চিঠিতে কীভাবে কারাগার কর্তৃপক্ষ তাঁকে ও অন্য বন্দীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে ও চালাচ্ছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন। কোয়ালিন তাঁর চিঠিতে বলেছেন, বন্দীদের জোর করে বিভিন্ন অপরাধের দায় স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়। দায় স্বীকার করলে সেসব ভিডিও ধারণ করে পরে রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেখানো হয়।
মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানজুড়ে প্রায় চার মাস ধরে চলা বিক্ষোভের প্রশংসা করে কোলিয়ান চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার বন্দিজীবনের চতুর্থ বছরে এসে অবশেষে আমি ইরানের চারদিক থেকে স্বাধীনতার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। এভিন কারাগারের পুরো প্রাচীর ভেদ করেও নারী, জীবন ও স্বাধীনতার জন্য মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছি।’
কারাগারে থেকেই বর্তমানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন কোলিয়ান। তিনি তাঁর চিঠিতে এভিনের কথিত ‘সাংস্কৃতিক’ শাখার বর্ণনা দিয়েছেন। এই শাখার অধীনেই আইন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। সে বর্ণনায় কোলিয়ান লিখেছেন, কারাগারের এই সাংস্কৃতিক শাখা নামে যে ভবন আছে, সেখানে বন্দীদের নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বন্দীদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ।
কোলিয়ান লিখেছেন, ‘পরীক্ষার কক্ষ তরুণ-তরুণীদের দিয়ে ভরা। সেখানে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের শিকার বন্দীর চিৎকার শুনতে পাই।’
গত ২৮ ডিসেম্বর কোলিয়ানের পরীক্ষা ছিল। ওই দিন ওই ‘সাংস্কৃতিক শাখায়’ পরীক্ষা দিতে যান তিনি। সেদিন সেখানে কী দেখেছেন, তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। চিঠিতে কোলিয়ান লিখেছেন, ‘ওই দিন ছিল হাড় হিম করা শীত। ভবন থেকে বের হওয়ার দরজায় তুষার পড়ছিল। কম বয়সী একটা ছেলের চোখ। পরনে কিছুই নেই বললে চলে। তার পরনে ছিল শুধু পাতলা একটি টি-শার্ট। একজন তদন্ত কর্মকর্তার সামনে বসে আছে ওই তরুণ। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তাকে। তদন্তকারীর সামনে বসে ঠান্ডায় কাঁপছিল ওই তরুণ আর বলছিল, আল্লাহর দোহাই আমাকে আর মারবেন না। কিন্তু তদন্তকারীরা চাচ্ছিল তরুণ তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ স্বীকার করুক। এ সময় আমি ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন আমি চিৎকার করে তরুণকে বলি, দায় স্বীকার করবে না। অত্যাচারীরা নিপাত যাক।’
ইরানের মানবাধিকারকর্মীরা ২০০৯ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্ট নিউজ এজেন্সি (এইচআরএএনএ) নামে একটি সংবাদমাধ্যম চালু করেন। সংবাদ সংস্থাটির দেওয়া হিসাবে, মাসা আমিনির মৃত্যুর পর শুরু হওয়া বিক্ষোভের জেরে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫১৯ জন বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৯টি শিশুও আছে। এ ছাড়া আরও কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁরা এখন কারাগারে আছেন। বিক্ষোভকারীদের অন্তত ১০০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, বন্দীদের জোরপূর্বক জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে। মামলায় লড়তে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কোনো আইনজীবী নিয়োগ দিতেও পারেন না। বন্দীদের নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেও দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এমন বিক্ষোভকারীদের পরিবারের ওপর চাপ দিয়ে বলা হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি কাউকে যেন জানানো না হয়। কর্তৃপক্ষ অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে। যদিও সেপ্টেম্বরে গণবিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কয়েক ডজন বন্দী বিক্ষোভকারীর দায় স্বীকার করে দেওয়া জবানবন্দি টিভিতে সম্প্রচার করা হয়েছে।
চিঠিতে কোলিয়ান ২০১৮ সালে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ ও জোরপূর্বক দায় স্বীকার করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছেন। ইরানের খুজেস্তান প্রদেশে একটি চিনি কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ-ধর্মঘটের পক্ষে কথা বলেছিলেন তিনি। এ জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ইভিন কারাগারে নির্যাতনের শিকার হন কোলিয়ান।
কোলিয়ানকে কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন একজন নারী তদন্ত কর্মকর্তা। কোলিয়ানের ধারণা ছিল, নারী হওয়ার কারণে ওই তদন্ত কর্মকর্তা হয়তো পুরুষ তদন্ত কর্মকর্তাদের তুলনায় কিছুটা ‘নরম ও কোমল’ হবেন। কোলিয়ান আশা করেছিলেন, ওই নারী তাঁর ওপর যৌন নির্যাতন চালাবেন না। কিন্তু সেটা আর হয়নি।
চিঠিতে কোলিয়ান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হওয়ার পর মুহূর্তেই তাঁর এ আশা হতাশা ও নির্মমতায় রূপ নেয়। ওই নারী কর্মকর্তা কোলিয়ান যেখানে বসে ছিলেন, সেখানে লাথি দিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকার করে কোলিয়ানকে বলতে থাকেন, ‘তুই একজন কমিউনিস্ট বেশ্যা। এখন বল তুই কার কার সঙ্গে শুয়েছিস?’
এরপর ওই নারী তদন্ত কর্মকর্তা কোলিয়ানের চোখের বাঁধন খুলে দেন এবং কার কার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ছিল ক্যামেরার সামনে সেটা স্বীকার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কোলিয়ান তা করতে অস্বীকৃতি জানান। কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর কোলিয়ান টয়লেটে যেতে দেওয়ার অনুরোধ করেন। একপর্যায়ে কোলিয়ানকে নিয়ে টয়লেটের দিকে যান ওই নারী তদন্ত কর্মকর্তা। তবে কোলিয়ান টয়লেটে ঢোকার পর বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। এতে টয়লেটে আটকা পড়েন কোলিয়ান।
কোলিয়ানের চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী, যে টয়লেটে তাঁকে আটকে রাখা হয়, সেটিও একটি জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ। সেখান থেকেই তিনি এক ব্যক্তিকে নির্যাতন করার শব্দ শুনতে পান। একটা পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার ওই ব্যক্তির কান্নার শব্দ কানে আসে তাঁর। কোলিয়ান চিঠিতে লিখেছেন, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা অথবা এক দিন ধরে আমি ওই ব্যক্তিকে নির্যাতন ও তাঁর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। আমার মনে হয় এক দিন ধরে টানা তাঁর ওপর নির্যাতন চলে। কারণ, তখন আমার সময়জ্ঞান ছিল না।’
কোলিয়ান বলেন, টয়লেট থেকে বের করে আনার পর তাঁকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হয়। টানা তিন চলে জিজ্ঞাসাবাদ। এই সময়ে তিনি এক মুহূর্তের জন্য ঘুমাননি। এ সময় তাঁর চেতনা ঠিকমতো ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কক্ষে গিয়ে দেখেন সেখানে ক্যামেরা বসানো।
চিঠিতে কোলিয়ান লিখেছেন, ‘ওই কক্ষে যাওয়ার পর ওই নারী তদন্ত কর্মকর্তা আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন। আমাকে কী বলতে হবে, সেটাই বোধ হয় লেখা ছিল সেখানে। কারণ, আমি তখন প্রায় বেহুঁশ। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ওই অবস্থায় কাগজটি হাতে নিয়ে আমি পড়ি। ওই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা হয়।’ কোলিয়ান কারাগার থেকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ওই কাগজ পড়ার মাধ্যমে তিনি যা বলেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
চলমান এ বিক্ষোভকে ‘বিপ্লব’ অভিহিত করার মধ্য দিয়ে চিঠি শেষ করেছেন কোলিয়ান। লিখেছেন, ‘আজ মারভিন, ইজেহ, রাশত, সিসতান, বেলুচিস্তান এবং সারা ইরানের রাস্তা থেকে যে শব্দ শুনেছি, তা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের শব্দের চেয়েও তার জোর বেশি। এটাই বিপ্লব, নারী, জীবন ও স্বাধীনতার সত্যিকার প্রতিধ্বনি।’