রমজান মাসের শেষ শুক্রবার পবিত্র জুমাতুল বিদার নামাজ আদায়ে আল-আকসা মসজিদে প্রবেশে মুসল্লিদের বাধা দিচ্ছেন ইসরায়েলি সেনারা। গত শুক্রবার পূর্ব জেরুজালেমে আল-আকসা চত্বরে
রমজান মাসের শেষ শুক্রবার পবিত্র জুমাতুল বিদার নামাজ আদায়ে আল-আকসা মসজিদে প্রবেশে মুসল্লিদের বাধা দিচ্ছেন ইসরায়েলি সেনারা। গত শুক্রবার পূর্ব জেরুজালেমে আল-আকসা চত্বরে

ফিলিস্তিন

বেদনা নিয়ে পবিত্র রাত পার

পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার এবং পবিত্র শবে কদর অত্যন্ত উদ্বেগ, বেদনা আর অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে কাটাল ফিলিস্তিনবাসী। জেরুজালেমে এদিন মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে ঢোকার পথ নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েলি পুলিশ। সেখানে নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায় তারা।

গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। আজ হামলার ছয় মাস পূর্তি হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে তাদের হামলায় সেখানকার দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আশ্রয়হীন, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ দিতেও বাধা দিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর মধ্যেই শুরু হয় পবিত্র রমজান মাস।

গত শুক্রবার জুমাতুল বিদায় নামাজ আদায়ে আল-আকসায় জড়ো হন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি মুসল্লি। গ্র্যান্ড মুফতি মুহাম্মদ আহমাদ হুসেইন ব্যাপক পুলিশি পাহারা সত্ত্বেও সবাইকে সাহস নিয়ে মসজিদে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

জেরুজালেমের বাসিন্দা ৫৩ বছর বয়সী আদলি আল-আঘা বলেন, শুক্রবার ফজরের নামাজ পড়েই অনেক মুসল্লিকে চলে যেতে হয়েছিল। কারণ, ওই সময় থেকেই মসজিদ এলাকায় জড়ো হওয়া লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করতে ইসরায়েলি পুলিশ ছোট ড্রোন থেকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। ওই সময় লোকজন স্লোগান দিতে শুরু করে। আঘা বলেন, ‘মুসল্লিরা ঘোষণা দেন আল-আকসার জন্য আমরা আত্মা ও রক্ত বিসর্জন দিয়েছি।’

ইসরায়েলি পুলিশ বলেছে, সন্ত্রাস উসকে দেওয়ায় তারা আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের বাসিন্দা ইয়াসের বাসা বলেন, আল-আকসা মসজিদে যুবক ও তরুণদের ঢুকতে দিচ্ছিল না পুলিশ। কেবল ৫৫ বছর বয়সের বেশি পুরুষ ও নারীর সেখানে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছিল। যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি না হতো, তবে পরিস্থিতি আরও সহজ হতো।

গত শুক্রবার ছিল পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। এর অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবে কদরের আরবি হলো লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। এই রাত মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত মহিমান্বিত একটি রাত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই রাত ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটান। এই রাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তাই মুসলমানদের কাছে এ রাত অতীব পুণ্যময় ও মহিমান্বিত।

কিন্তু ফিলিস্তিনবাসীর জন্য এ রাত উদ্‌যাপনের বা ছয় মাস ধরে চলা রক্তপাত বন্ধ করতে প্রার্থনা করার মতো পরিস্থিতির কোনো রাত ছিল না।

বেথলেহেমের কাছ থেকে আসা ৫৫ বছর বয়সী সামিহা আল কাদি বলেন, ‘জেরুজালেম অত্যন্ত দুঃখী আর এটি তার উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। গাজায় যা ঘটছে, তা আমরা অনুভব করতে পারছি। আমরা এক মিনিটের জন্য তা থেকে পালাতে পারছি না। গাজাবাসীরাও অত্যন্ত বেদনা আর কষ্টে কাটিয়েছে রাতটি।’

এ বছর পবিত্র এ জেরুজালেম শহরে রমজানের আলোকসজ্জা বা সাজসজ্জা চোখে পড়েনি। প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দিকে মঙ্গলবার বা বুধবার যে ঐতিহ্যবাহী ইফতারের আয়োজন করা হয়, এবার তা-ও হয়নি। এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনবাসী তিতা কফি আর একটি খেজুর দিয়ে কোনোরকমে ইফতার করেছেন।

গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে স্বজন হারিয়েছেন ৫৪ বছর বয়সী সাবাহ। তিনি বলেন, ‘এ বছর মানুষের মনে কোনো উদ্‌যাপন নেই। এ বছরের ইফতারে কোনো মিষ্টি কিছু নেই। আমার মুখে সবকিছুই এখন তেতো মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার পুরো পরিবারের জন্য এটা খুবই বেদনাদায়ক।’

জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে মিষ্টি বিক্রেতা ৬০ বছর বয়সী আদনান জাফর বলেন, সাধারণত রোজার মাসে তাঁর দোকানে অনেক ব্যস্ততা যায়। কিন্তু এ বছরের রোজার মতো আর কখনো এমন পরিস্থিতি দেখেননি তিনি। জাফর বলেন, ‘এ পরিস্থিতি কেন, আমরা সবাই তা জানি। গাজা পরিস্থিতি শুধু আমাদের প্রভাবিত করছে না, পুরো বিশ্বকে প্রভাবিত করছে।’

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালালে ১ হাজার ১৭০ বেসামরিক লোক মারা যান। এরপর থেকে গাজায় পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে গাজায় ৩৩ হাজার ৯১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

ওআইসির নিন্দা

শুক্রবার জুমাতুল বিদায় হাজারো মুসল্লিকে আল-আকসা মসজিদে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আল-আকসা মসজিদে মুসল্লিদের ওপর নির্লজ্জ আক্রমণ ও মসজিদ আঙিনায় তাদের ওপর বিষাক্ত গ্যাসবোমা এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম, আইন এবং মানবিক মূল্যবোধ লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল।