ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান
ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান

ইসরায়েল কোথা থেকে এত অস্ত্র পায়

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যেভাবে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার জেরে দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের জন্য পশ্চিমা সরকারগুলো চাপের মুখে পড়েছে।

ইসরায়েল বিশ্বের একটি বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। তবে আকাশপথে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আমদানি করা যুদ্ধবিমান, গাইডেড বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। গাজায় ইসরায়েল আকাশপথে চালানো সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা তাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম তীব্র ও ধ্বংসযজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন।

বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠী ও ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোর কিছু রাজনীতিবিদ বলেছেন, দেশটির কাছে অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করা উচিত। কারণ, ইসরায়েল বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষাসহ তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিতে যথেষ্ট কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

গত সোমবার যুক্তরাজ্য বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মানার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অবস্থান তারা পর্যালোচনা করেছে। এই পর্যালোচনার আলোকে তারা গাজায় সামরিক অভিযানে ব্যবহারের জন্য ইসরায়েলের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে—এমন প্রায় ৩০টি রপ্তানি লাইসেন্স স্থগিত করছে।

ইসরায়েল যত অস্ত্র আমদানি করে, সেই বিবেচনায় দেশটিতে যুক্তরাজ্যের রপ্তানির পরিমাণ তুলনামূলক কম। এরপরও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের এ সিদ্ধান্তকে ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করে নিন্দা জানিয়েছেন।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এ হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ২৫১ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। এ হামলার জেরে গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে উপত্যকাটির হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

ইসরায়েল জোর দিয়ে বলে আসছে, ইসরায়েলি বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত হওয়ার ঘটনা এড়াতে কাজ করছে। ইসরায়েলের দাবি, হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের সংঘাতের মধ্যে ফেলছে। আর গাজায় সাহায্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও কোনো বাধা নেই।

যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েলের আয়রন ডোম ব্যবস্থা

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েলের প্রধান প্রচলিত অস্ত্র আমদানির ৬৯ শতাংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

যুক্তরাষ্ট্র ১০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তির আওতায় ইসরায়েলকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বার্ষিক সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য ইসরায়েলকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে গুণগত সামরিক শক্তিতে এগিয়ে রাখা।

সহায়তার একটি অংশ (বার্ষিক ৫০০ মিলিয়ন ডলার) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কর্মসূচিতে অর্থায়নের জন্য আলাদা করা হয়েছে। এ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে যৌথভাবে আয়রন ডোম, অ্যারো ও ডেভিডস স্লিং ব্যবস্থার বিকাশ।

গাজার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে ‘আত্মরক্ষা’য় এগুলোর ওপর নির্ভর করে আসছে ইসরায়েল।

হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এসআইপিআরআই বলেছে, ২০২৩ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত হাজার হাজার গাইডেড বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে সরবরাহ করেছে। তবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানির মোট পরিমাণ ২০২২ সালের মতোই ছিল প্রায়।

মার্কিন কংগ্রেসের পর্যালোচনা এড়িয়ে জরুরি কর্তৃত্ব ব্যবহার করার পর গত ডিসেম্বরে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলে দুই দফা অস্ত্র বিক্রির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে।

এক দফায় ছিল ১০ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের ১৪ হাজার ট্যাংকের গোলাবারুদ। দ্বিতীয় দফায় ছিল ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার মূল্যের আর্টিলারি শেল (১৫৫ মিমি) তৈরির উপকরণ।

মার্কিন গণমাধ্যম গত মার্চে জানায়, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তখন পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন চুপিসারে ইসরায়েলের কাছে ১০০টির বেশি ধাপে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মূল্য ডলারের হিসেবে এমন পরিমাণ ছিল, যে ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর দরকার হয় না।

এসব অস্ত্রের মধ্যে হাজার হাজার গাইডেড বোমা, ছোট ব্যাসের বোমা, বাংকার বাস্টার ও ছোট অস্ত্র ছিল বলে জানা গেছে।

গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান আটকে দেয়। কারণ, কংগ্রেসে বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধিরা, এমনকি দলটির সমর্থকেরা ফিলিস্তিনের দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে ইসরায়েলের স্থল অভিযানের পরিকল্পনার বিষয়ে ক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, ২ হাজার পাউন্ডের ১ হাজার ৮০০ বোমা ও ৫০০ পাউন্ডের ১ হাজার ৭০০ বোমা ঘনবসতিপূর্ণ শহর এলাকায় ব্যবহার করা হলে তাতে বেসামরিক নাগরিক নিহত হতে পারেন—এমন উদ্বেগের কারণেই এ অস্ত্রের চালান আটকে রাখা হয়।

গত জুলাইয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, ৫০০ পাউন্ডের বোমার চালান সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হবে। কিন্তু বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানির বিষয়ে অব্যাহত উদ্বেগের কারণে দুই হাজার পাউন্ডের বোমার চালান আটকে রাখা হবে।

এরপর গত মাসে (আগস্ট) বাইডেন প্রশাসন কংগ্রেসকে জানায়, তারা ইসরায়েলে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে।

অনুমোদিত প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে ৫০টি এফ-১৫ আইএ যুদ্ধবিমান, ইসরায়েলের কাছে থাকা ২৫টি এফ-১৫ আই যুদ্ধবিমানের জন্য আপগ্রেড কিট। এই প্যাকেজের মূল্য ১৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া আছে ৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের অনির্দিষ্টসংখ্যক ৮ টনের কার্গো ট্রাক। ১০২ মিলিয়ন ডলারের ৩০টি মাঝারি পাল্লার ‘এয়ার-টু-এয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র। ৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের ৫০ হাজার মর্টার গোলা (১২০ মিমি)।

তবে ২০২৬ সালের আগে এসব অস্ত্রশস্ত্র ইসরায়েলের কাছে সরবরাহ করা হবে বলে মনে হয় না।

জার্মানি

ইসরায়েলের ড্রোন

যুক্তরাষ্ট্রের পর ইসরায়েলে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রপ্তানি করে জার্মানি। এসআইপিআরআইয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল যে অস্ত্র আমদানি করেছে, তার ৩০ শতাংশ জার্মানির।

২০২২ সালে ইসরায়েল তিনটি উন্নত ডাকার শ্রেণির ডিজেলচালিত সাবমেরিন কিনতে জার্মানির সঙ্গে ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলারের (৩ বিলিয়ন ইউরো) একটি চুক্তি করে। এগুলো ২০৩১ সালের পর থেকে সরবরাহ করা হতে পারে।

বর্তমানে ইসরায়েলি নৌবাহিনী জার্মানির নির্মিত ডলফিন শ্রেণির সাবমেরিন ব্যবহার করে। এগুলোর স্থলে তারা ডাকার শ্রেণির ডিজেলচালিত সাবমেরিন ব্যবহার করবে।

গত বছর ইসরায়েলের কাছে ইউরোপীয় দেশটির অস্ত্র বিক্রির আর্থিক মূল্য ছিল ৩৬ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৩২ কোটি ৬৫ লাখ ইউরো)। ২০২২ সালের তুলনায় তা ১০ গুণ বেশি। গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার পরই এই অস্ত্র রপ্তানি লাইসেন্সগুলোর বেশির ভাগ মঞ্জুর করা হয়েছিল।

জার্মান সরকার গত জানুয়ারিতে বলেছিল, বিক্রির প্যাকেজে ৩০ কোটি ৬৪ লাখ ইউরোর সামরিক সরঞ্জাম ও ২ কোটি ১০ লাখ ইউরোর যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে।

জার্মানির ডিপিএ নিউজ এজেন্সির তথ্যমতে, পরে ৩ হাজারটি বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র এবং স্বয়ংক্রিয় বা আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য ৫ লাখ গুলি বিক্রির বিষয়টি প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত হয়।

সংবাদ সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অস্ত্রের উন্নয়ন, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামতের জন্য স্থলযান ও প্রযুক্তির জন্য বেশির ভাগ রপ্তানি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ যুদ্ধের পুরোটা সময় ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। যদিও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তাঁর সুর বদল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জার্মানিতে বেশ বিতর্ক আছে। তবে এর জেরে ইসরায়েলের কাছে জার্মানির অস্ত্র বিক্রি স্থগিতের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ইতালি

ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির দিক থেকে ইতালির অবস্থান তৃতীয়। তবে এসআইপিআরআইয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল যত অস্ত্র আমদানি করেছে, তার মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ইতালির। আমদানি করা অস্ত্রসহ সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে হেলিকপ্টার ও নৌ আর্টিলারি অন্তর্ভুক্ত থাকার বিষয়টি জানা যায়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী দ্য ক্যাম্পেইন এগেইনস্ট আর্মস ট্রেড (সিএএটি) বলছে, ২০২২ সালে ইসরায়েলের কাছে ইতালির সামরিক পণ্যের রপ্তানি ও লাইসেন্সের মূল্য ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ইউরো (১ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার)।
ইতালির অর্থবিষয়ক একটি সাময়িকী দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ইসরায়েলের কাছে ইতালির অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রির অর্থমূল্য ছিল ১ কোটি ৩৭ লাখ ইউরো।

ইসরায়েলের ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক যান

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলের কাছে ২১ লাখ ইউরোর অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দেয় ইতালি। যদিও ইতালি সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, যুদ্ধ করছে বা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে মনে করা হয়—এমন দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করার একটি আইনের অধীন তারা এ চালান আটকে দিচ্ছে।

ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইডো ক্রসেটো গত মার্চে পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ঘটনা ধরে ধরে যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁরা বিদ্যমান চুক্তিগুলো রক্ষা করেছেন। তাঁরা নিশ্চিত করছেন, বিক্রির মধ্যে এমন সামগ্রী নেই, যা বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।

যুক্তরাজ্য

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্য সরকার বলেছিল, ২০২২ সালে ইসরায়েলের কাছে ব্রিটিশ সামরিক পণ্যের রপ্তানি অপেক্ষাকৃত কম ছিল। এর পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড (৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার)।

যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেডের নথি অনুসারে, এ সংখ্যা ২০২৩ সালে ১৮ দশমিক ২ মিলিয়ন পাউন্ডে নেমে আসে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মের মধ্যে ইসরায়েলে সামরিক পণ্য বিক্রির জন্য ৪২টি রপ্তানি লাইসেন্স ইস্যু করে যুক্তরাজ্য সরকার। আর এই সময়ে বিদ্যমান লাইসেন্স ছিল ৩৪৫টি।

যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেড বলেছে, লাইসেন্সের আওতায় থাকা সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে সামরিক বিমান, সামরিক যান ও যুদ্ধ নৌযানের উপাদান।

অস্ত্র হাতে ইসরায়েলি সেনা

ব্রিটিশ চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সিএএটি বলেছে, যুক্তরাজ্য ২০০৮ সাল থেকে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির জন্য মোট ৫৭ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ডের রপ্তানি লাইসেন্স দিয়েছে। এর বেশির ভাগই ছিল যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত উপাদানের জন্য।

চলতি সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত হয়—এমন সামগ্রীর জন্য দেওয়া প্রায় ৩০টি রপ্তানি লাইসেন্স অবিলম্বে স্থগিত করার ঘোষণা দেন।

ডেভিড ল্যামি বলেন, তিনি একটি মূল্যায়ন হাতে পেয়েছেন। যাতে এই উপসংহার টানা হয়েছে, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আশঙ্কা আছে, কিছু সামরিক সামগ্রী রপ্তানির বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতে পারে।

তবে ডেভিড ল্যামি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

লাইসেন্সগুলোর আওতায় সামরিক উড়োজাহাজের উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও ড্রোন। একই সঙ্গে স্থল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা সহজতর করার সামগ্রী আছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাজ্যের সিদ্ধান্তকে লজ্জাজনক ও ভুল পথে পরিচালিত বলে আখ্যায়িত করে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাজ্যের এ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা হামাসকে উৎসাহিত করবে। তিনি একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েল ন্যায়সংগত উপায়ে একটি ন্যায্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাশিল্প

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল নিজস্ব প্রতিরক্ষাশিল্প গড়ে তুলেছে। তারা এখন বিশ্বের নবম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক। এ ক্ষেত্রে তারা বড় পরিসরের হার্ডওয়্যারের পরিবর্তে উন্নত প্রযুক্তিগত সামরিক পণ্যগুলোর ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে।

এসআইপিআরআইয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অস্ত্র বিক্রিতে ইসরায়েলের অবদান ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র আমদানিকারক প্রধান তিনটি দেশ হলো ভারত (৩৭ শতাংশ), ফিলিপাইন (১২ শতাংশ) ও যুক্তরাষ্ট্র (৮ দশমিক ৭ শতাংশ)।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাসামগ্রী রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

এই রপ্তানির মধ্যে আছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা (৩৬ শতাংশ), রাডার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধব্যবস্থা (১১ শতাংশ), ফায়ার ও অস্ত্র উৎক্ষেপণ সরঞ্জাম (১১ শতাংশ) এবং ড্রোন ও এভিওনিক্স (৯ শতাংশ)।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, অর্থাৎ গাজা যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে ইসরায়েলের কাছ থেকে অত্যাধুনিক অ্যারো ৩ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনতে ৩৫০ কোটি ডলারের একটি চুক্তিতে সম্মত হয় জার্মানি। এটি দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রুখতে ব্যবহৃত হয়।

এটি ইসরায়েলের সর্ববৃহৎ প্রতিরক্ষা রপ্তানি চুক্তি। চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রও অনুমোদন দিয়েছিল। কারণ, তারা যৌথভাবেই এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে।

ইসরায়েলে মার্কিন সামরিক মজুত

১৯৮৪ সালে ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্রের একটি বড় ভান্ডার স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। আঞ্চলিক সংঘাতের সময় যাতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের দ্রুত এখান থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা যায়, সে জন্যই ভান্ডারটি স্থাপন করা হয়। পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে দ্রুত অস্ত্র দেওয়াটাও এই ভান্ডার স্থাপনের একটি উদ্দেশ্য।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় হামলা শুরু করে রাশিয়া। এই আগ্রাসনের পর ইসরায়েলে থাকা মার্কিন ভান্ডার থেকে ইউক্রেনে প্রায় ৩ লাখ আর্টিলারি শেল (১৫৫ মিমি) পাঠায় পেন্টাগন।

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর একই ভান্ডার থেকে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করা হয় বলে জানা গেছে।