ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে আইসিসির সম্ভাব্য পরোয়ানায় কেন উদ্বিগ্ন ইসরায়েল

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ছয় মাসের বেশি পার হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ শীর্ষস্থানীয় ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে ক্রমেই বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন তেল আবিবের কর্মকর্তারা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এ পরোয়ানা জারি করতে পারেন।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতের সম্ভাব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ ভাষায় একটি পোস্ট দেন নেতানিয়াহু। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলেছে, আইসিসির পদক্ষেপ নিয়ে প্রকাশিত খবরাখবরের ওপর তারা নজর রাখছে।

বিশ্বে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও আগ্রাসন চালানোর মতো নৃশংসতম কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্থায়ী আদালত আইসিসি।

যে রোম সনদের ভিত্তিতে আইসিসির প্রতিষ্ঠা, সেটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৮ সালে। ৬০টি দেশের অনুসমর্থনের পর  ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে কাজ শুরু করে আন্তর্জাতিক এ আদালত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আইসিসিকে অনুমোদন দিলেও এ আদালত মূলত স্বাধীন।

নিজস্ব পুলিশ বাহিনী না থাকায় আইসিসি সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সদস্যদেশগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকে। এমন ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে এটি এক বড় বাধা।

নিজস্ব পুলিশ বাহিনী না থাকায় আইসিসি সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সদস্যদেশগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকে। এমন ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে এটি এক বড় বাধা।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত শুক্রবার এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে লেখেন, ‘ইসরায়েল তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সহজাত অধিকার ক্ষুণ্ন করে—আইসিসির এমন কোনো চেষ্টা মেনে নেবে না।’

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আরও লেখেন, ‘যদিও আইসিসির নির্দেশ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলবে না, তবু এটি এক বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করবে।’

প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বার্তার পর ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রোববার বলেছে, আদালত ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারে—এমন ‘সব গুজব’ সম্পর্কে বিদেশি মিশনগুলোকে অবগত করেছে তারা। তবে এ গুজবের সূত্র সম্পর্কে মন্ত্রণালয় কিছু জানায়নি।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে এক ই–মেইল বার্তায় এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আদালতের প্রসিকিউশন দপ্তর।

আইসিসি কী ও এর কার্যক্রম

আইসিসির ১২৪টি সদস্যদেশ রোম সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে অনেক দেশই এ সনদে সই করেনি এবং যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে আইসিসির বিচার করার এখতিয়ার মানে না। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন।

কোনো দেশ যখন তার ভূখণ্ডে সংঘটিত এ ধরনের অপরাধের বিচার করতে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক হয়, তখন আইসিসি এতে হস্তক্ষেপ করে। ইসরায়েল যুক্তি দেয় যে তাদের কার্যকর বিচারব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া কোনো ঘটনায় একটি দেশের বিচারিক সক্ষমতা বা বিচারের ইচ্ছা নিয়ে বিতর্ক, অতীতে এ আদালত ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিবাদ উসকে দিয়েছে।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আইসিসির কৌঁসুলি ও এর প্রসিকিউশন দপ্তরের অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়। আফগানিস্তানে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলোর সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত করছিলেন আইসিসির কর্মকর্তারা।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে চলা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ২০২১ সালে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

আইসিসি বর্তমানে ১৭টি ঘটনা তদন্ত করছে। এসব ঘটনায় জারি করেছে ৪২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে ২১ সন্দেহভাজনকে। ইতিমধ্যে আদালতের বিচারকেরা ১০ সন্দেহভাজনকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন ও খালাস দিয়েছেন চারজনকে।

যাত্রা শুরুর প্রথম দিকের বছরগুলোয় আফ্রিকায় সংঘটিত অপরাধের দিকে বেশি নজর দেওয়ায় আইসিসির বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়। তাঁর তদন্ত করা ঘটনাগুলোর মধ্যে ১০টিই ছিল আফ্রিকার দেশগুলো নিয়ে। তবে এখন এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো নিয়ে তদন্ত করছেন আদালত।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সঙ্গে আইসিসির সম্পর্ক

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০১২ সালে ফিলিস্তিনের মর্যাদা জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষক থেকে সদস্য—নয় এমন পর্যবেক্ষক দেশে উন্নীত করে। এতে আইসিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগদান করার সুযোগ তৈরি হয় ফিলিস্তিনের।
ফিলিস্তিনিরা আদালতের এখতিয়ার গ্রহণ করার এক বছর পর ২০১৫ সালে ‘দ্য স্টেট অব প্যালেস্টাইন’কে তাঁর সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন আইসিসি।

২০২১ সালে আদালতের সেই সময়ের প্রধান কৌঁসুলি ঘোষণা করেন, ফিলিস্তিনে সংঘটিত সম্ভাব্য অপরাধ নিয়ে তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছেন তিনি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েল প্রায়ই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করে থাকে। আর নেতানিয়াহু আদালতের ওই সিদ্ধান্তকে ‘ভণ্ডামি ও ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে নিন্দা জানান।

আদালতের বর্তমান কৌঁসুলি করিম খান গত ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনের রামাল্লা ও ইসরায়েল সফর করেন। এসব সফরে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ছাড়াও গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত বা জিম্মি হওয়া ইসরায়েলি নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

করিম খান হামাসের ওই কর্মকাণ্ডকে ‘অত্যন্ত গুরুতর কিছু আন্তর্জাতিক অপরাধ; যা মানবতার বিবেককে নাড়া দেয় এবং এসব এমন অপরাধ; যা বিবেচনায় নিতে আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল’ বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে জিম্মিদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান।

আইসিসির এই কৌঁসুলি বলেন, ‘ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অবশ্যই প্রয়োগ করা হবে এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও জানে, এ আইন অবশ্যই প্রয়োগ করা হবে।’ সফর শেষে করিম খান বলেন, ‘হামাস যোদ্ধা ও ইসরায়েলি বাহিনীর সম্ভাব্য অপরাধে আইসিসির তদন্ত করাটা হবে আমার দপ্তরের অন্যতম অগ্রাধিকার।’

দ্য হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত

আইসিসি আর কাকে অভিযুক্ত করেছে

ইউক্রেন থেকে শিশুদের অপহরণ করার অভিযোগে এক বছর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। জবাবে করিম খান ও আইসিসির বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নিজস্ব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে রাশিয়া।

আদালত শীর্ষ পর্যায়ের আরও যেসব নেতাকে অভিযুক্ত করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুদানের ক্ষমতাচ্যুত নেতা ওমর আল-বশির ও লিবিয়ার সাবেক নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফি। সুদানের দারফুরে গণহত্যা চালানোসহ অন্যান্য অভিযোগে বশিরকে অভিযুক্ত করা হয়। আর ২০১১ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ নিষ্ঠুর হাতে দমন করায় অভিযুক্ত করা হয় গাদ্দাফিকে। এ ঘটনায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কয়েক দিন পরই লিবীয় এ নেতাকে আটক এবং হত্যা করেন বিদ্রোহীরা।