ফিলিস্তিনের দখলকৃত পশ্চিম তীরে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়ক লিন হিসটিংসের ভিসা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল বুধবার ৬ ডিসেম্বর এই ঘোষণা দেয় দেশটি।
ভিসা বাতিলের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) কড়া ভাষায় পোস্ট দিয়েছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন। তিনি লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি হামাসের নৃশংসতায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানান না, কিন্তু ইসরায়েলের নিন্দা জানান, যে গণতান্ত্রিক দেশটি তার নাগরিকদের রক্ষার চেষ্টা করছে... এমন প্রেক্ষাপটে ওই ব্যক্তি জাতিসংঘে কাজ করতে পারেন না, তিনি ইসরায়েলে ঢুকতে পারেন না।’
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এতে করে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। জবাবে ওই দিন থেকেই গাজায় হামাসকে নির্মূলের নামে নির্বিচার হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে করে এ পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।
শুরু থেকেই ইসরায়েলের এমন নির্বিচার হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার জাতিসংঘ। এর জেরে একের পর এক ইসরায়েলের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে বিশ্ব সংস্থাটিকে।
গত সোমবার ৪ ডিসেম্বর গাজার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন লিন হিস্টিংস। তিনি বলেন, ‘গাজায় ত্রাণ সহায়তা পরিচালনার মতো পরিস্থিতি নেই।’
জাতিসংঘের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গাজায় আরও নারকীয় পরিস্থিতি হয়তো উন্মোচিত হতে চলেছে। এ কারণে সেখানে মানবিক সহায়তা পরিচালনা করা সম্ভব নাও হতে পারে।’ এ সময় তিনি এক সপ্তাহের সাময়িক যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ পুনরায় শুরুর কথাও উল্লেখ করেন।
গত ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৩০ কর্মী নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে কোনো একক সংঘাতে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
হিস্টিংসের এমন বক্তব্য জাতিসংঘের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সর্বশেষ ঘটনা। তাঁর ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল তাঁকে দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল থেকে বহিষ্কার করতে চাইছে।
গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল থেকে বেসামরিক মানুষদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যেতে বলে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এরপর গত ২৫ অক্টোবর জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ভিসা দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান।
গাজায় আরও নারকীয় পরিস্থিতি হয়তো উন্মোচিত হতে চলেছে। এ কারণে সেখানে মানবিক সহায়তা পরিচালনা করা সম্ভব নাও হতে পারে।লিন হিসটিংস, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়ক, পশ্চিম তীর
গত ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ভয়ংকর এক হামলা চালিয়েছে হামাস। তবে এ হামলা যে হঠাৎ শূন্য থেকে (কারণ ছাড়া) হয়নি, এটাও সবাইকে বুঝতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার।
এর জেরে গত ১৪ নভেম্বর গুতেরেসের বিরুদ্ধে সরব হন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলে হামাস যেভাবে হামলা চালিয়েছে, গুতেরেস সে ব্যাপারে যথাযথ নিন্দা জানাননি। এ কারণে তিনি জাতিসংঘে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নন।
সংঘাতের প্রায় দুই মাস পর কাতারের মধ্যস্থতায় গত ২৪ নভেম্বর ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ৩০ নভেম্বর শেষ হয় এই যুদ্ধবিরতি। এই সময়ে হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিকদের মুক্তি দেওয়া হয়। অপরদিকে ইসরায়েলের কারাগারে থাকা বেশ কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গত ২৯ নভেম্বর ইসরায়েলি সাংবাদিক আলমং বোকার অভিযোগ করেন, হামাসের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া একজন জিম্মিকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) পরিচালিত একটি স্কুলশিক্ষকের কাছে রাখা হয়েছিল।
ইসরায়েলি সাংবাদিকের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১ ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দেয় ইউএনআরডব্লিউএ। বিবৃতিতে এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয়।
ইউএনআরডব্লিউএর বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুতর বিবেচেনা করে তারাসহ জাতিসংঘের অন্যান্য শাখা থেকে ইসরায়েলি ওই সাংবাদিকের কাছে এ বিষয়ে বিশদ তথ্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু দফায় দফায় যোগাযোগ করেও ওই সাংবাদিকের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইউএনআরডব্লিউএর প্রতি ইসরায়েলের আগ্রাসন শুধু সংস্থাটির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সংস্থাটির বেশ কিছু বিদ্যালয় ইসরায়েলি বোমা হামলার শিকার হয়েছে।
গত ১৮ নভেম্বর ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত আল-ফাখুরা বিদ্যালয়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর পাঁচ দিন পরে ২৩ নভেম্বর আবু হুসেইন নামের আরেকটি বিদ্যালয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারান ২৭ জন।
এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজাজুড়ে জাতিসংঘের পরিচালিত ৪৭টি বিদ্যালয় ধ্বংস হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৩০ কর্মী নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে কোনো একক সংঘাতে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৭ কর্মী আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে ইউএনআরডব্লিউএ।
গত সোমবার ৪ ডিসেম্বর এক এক্স–বার্তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, গাজার দক্ষিণাঞ্চল থেকে তাদের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরিয়ে নিতে বার্তা দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
ডব্লিউএইচও মহাপরিচালক এক্সে লিখেছেন, ‘আমরা ইসরায়েলকে এমন বার্তা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে হাসপাতাল ও মানবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বেসামরিক নাগরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামো রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।’
তবে এই ধরনের বার্তা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সংস্থা সিওজিএটি এক্সে লিখেছে, ‘জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তার কাছে থেকে আরও বেশি নির্ভুল বক্তব্য আশা করছি।’