ফিলিস্তিনের দখল করা পশ্চিম তীরের একটি গ্রাম ওয়াদি আস-সাইক। ইসরায়েলের সেনা ও পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারী একদল ইসরায়েলি অস্ত্রের মুখে ১২ অক্টোবর গ্রামটি থেকে হাত–পা বেঁধে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে দিনভর তাঁদের ওপরে চলে অকথ্য নির্যাতন।
সেদিন ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের হাতে তাঁদের ওপর কী নির্মম নির্যাতন হয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন সেই তিন ফিলিস্তিনি। ভয়াবহ সে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তাঁরা বলেন, হাত বাঁধার পর থেকেই বেধড়ক মারধর করা হতে থাকে তাঁদের। খুলে নেওয়া হয় তাঁদের পরনের জামাকাপড়। নগ্ন করার পর তোলা হয় ছবি। তাঁদের মধ্যে দুজনের শরীরে প্রস্রাবও করে দেওয়া হয়। সিগারেটের আগুনে দেওয়া হয় ছ্যাঁকা। একজনের পায়ুপথে লাঠি ঢোকানোর চেষ্টাও চলে।
একই দিন ইসরায়েলের সেনা ও বসতি স্থাপনকারীরা তিন বামপন্থী ইসরায়েলি অধিকারকর্মীকেও আটক করে। আটক ইসরায়েলিদের তিন ঘণ্টা পর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিন ফিলিস্তিনির ওপর সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্যাতন চলে। পরে সন্ধ্যায় ছেড়ে দিয়ে পাঠানো হয় রামাল্লার এক হাসপাতালে।
নির্যাতনের শিকার সেই ফিলিস্তিনিরা বলেন, তাঁদের বলা হয় যে শিন বেতের (ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা) সদস্যরা তাঁদের আটক করেছে। কিছুক্ষণ পর বেসামরিক গাড়িতে কয়েকজন (তারা ধারণা করেছিল শিন বেতের সদস্য) আসে। তারা এলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো হয়।
সেদিনের এই ঘটনার শিকার তিন ফিলিস্তিনি এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিন ইসরায়েলি অধিকারকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ। তিন ফিলিস্তিনির মধ্যে যে দুজন সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা কিছু ছবিও পাঠিয়েছেন। ছবিগুলোতে দেখা যায়, পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। আঘাতে আঘাতে কালশিটে দাগ পড়েছে শরীরে। কোথাও রয়েছে পোড়ানোর ক্ষত।
ইরাকে আবু গারিব কারাগারের কথা শুনেছেন? শুনেছি, সেখানেও ঠিক এভাবে নির্যাতন করা হয়। এটা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আবু গারিব।আবু হাসান, নির্যাতনের শিকার তিন ফিলিস্তিনির একজন
নির্যাতনের শিকার তিন ফিলিস্তিনির একজন আবু হাসান। তিনি হারেৎজকে বলেন, ‘ইরাকে আবু গারিব কারাগারের কথা শুনেছেন? শুনেছি, সেখানেও ঠিক এভাবে নির্যাতন করা হয়।’ তাঁর শরীর এখনো ব্যথায় জর্জরিত জানিয়ে আবু হাসান বলেন, ‘এটা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আবু গারিব।’
অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের একের পর এক হামলা চলছে ওয়াদি আস–সাইক গ্রামে। হামলার মুখে বাসিন্দাদের অনেকে পালিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ অক্টোবর তিন ফিলিস্তিনিকে ওই গ্রাম থেকে আটক করা হয়। এর মধ্যে দুজন হলেন মোহাম্মদ খালেদ (২৭) ও আবু হাসান (৪৬)। রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ‘ওয়াল ও সেটেলমেন্ট রেজিস্ট্যান্স কমিশন’ নামে একটি সংস্থার কর্মী তাঁরা।
আবু হাসান বলেন, ‘আমরা গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমরা একটি পিকআপ ট্রাক দেখতে পাই। সেই গাড়িতে ছিল সেনাবাহিনীর উর্দি পরা একদল বসতি স্থাপনকারী। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র। কেউ কেউ ছিলেন মুখোশ পরা। আমাদের সামনে এসে গাড়িটি থামল। অস্ত্র হাতে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল ২০ থেকে ২৫ জন। নেমেই তারা সোজা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়াল।’
গাড়িতে করে গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁদের যেভাবে নির্যাতন করা হয়, তার বিবরণ উঠে এল দুই ফিলিস্তিনির কথায়। তাঁরা জানালেন, গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর উর্দি পরা বসতি স্থাপনকারীরা তাঁদের মেঝেতে ফেলে অস্ত্র দিয়ে মারধর শুরু করে। মাথা মেঝেতে ঠেসে ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করে। এরপর দড়ি দিয়ে তাঁদের হাতগুলো বেঁধে ফেলা হয়।
এর মধ্যে ইসরায়েলের ‘সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ সেনারা সেখানে আসে। তখনো হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা ফিলিস্তিনিদের। এসেই সেই সেনারা তাঁদের তিনজনকে বলেন, তাঁদের যারা ধরে নিয়ে এসেছে, তারা সেনাসদস্য। আবু হাসান প্রশ্ন করেন, ‘আপনি নিশ্চিত তারা সেনাসদস্য? কারণ, আমার জানামতে তারা বসতি স্থাপনকারী। এই তো পাশেই তাদের বাড়ি। কিন্তু তিনি আমার কথায় কর্ণপাতই করলেন না। বরং একাধিকবার দাবি করলেন, বসতি স্থাপনকারী নয়, তারা সেনাসদস্য।’
খালেদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেনা–বসতি স্থাপনকারীরা তাঁদের জানায় শিন বেত তাদের আটক করেছে। শিন বেতের সদস্যরা শিগগিরই আসবে। খালেদ বলেন, এ কথা বলার কিছুক্ষণ পর একটি সাদা গাড়িতে উর্দি পরা ছয় থেকে আটজন আসে। তাদের শিন বেতের সদস্য মনে করেছিলেন তাঁরা।
গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পালালেও আমি আটক হয়ে যাই। আমাকে রাইফেল ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। দড়ি দিয়ে হাত বাঁধে। তখন প্রচণ্ড গরম। আমার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। বারবার চেতনা হারাচ্ছিলাম।মাজিদ, নির্যাতনের শিকার এক ফিলিস্তিনি
গাড়িটি আসার পর তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এরপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁকা একটি ভবনে। নিয়ে ফেলে রাখা হয় একটি খালি মেঝেতে। কাপড় দিয়ে তাদের চোখও বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর দড়ি খুলে ধাতব তার দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় হাত। দুই ফিলিস্তিনি বলেন, সেই ভবনে পশু–প্রাণী রাখা হয় বলে মনে হয়েছে তাঁদের। কারণ, সেখানে নানা ধরনের বিষ্ঠা পড়ে ছিল।
আবু হাসান বলেন, ‘আমাদের মুখ মেঝেতে ঠেলে ধরে রাখা হয়। পরে তাদের একজন একটি ছুরি দিয়ে আমাদের পরনে থাকা পোশাক কেটে দেয়। এরপর অন্তর্বাস ছাড়া আমাদের শরীরে কিছু ছিল না।’ এ সময় নির্যাতনকারীরা মোট কতজন ছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও হাসান বললেন, ‘৮ থেকে ১০ জন হবে।’
নির্যাতনের শিকার অপর ফিলিস্তিনি খালেদ বলেন, ‘আমাদের বেধড়ক পিটুনি চলতেই থাকে। লোহার পাইপ দিয়ে হাত, বুক এমনকি মাথায় পর্যন্ত বারবার আঘাত করা হয়। শরীরের প্রতিটি জায়গায় পেটায়। সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেয়। আমার হাতের নখ তুলে নেওয়ারও চেষ্টা করে।’
দিনভর নির্যাতনের পর ভবন থেকে বের করে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তখনো তাঁদের হাত ছিল বাঁধা। পরনেও ছিল শুধু অন্তর্বাস। এ সময় তাঁদের ছবি তোলা হয়। পরে সেসব ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে।
গালাগালি চলতে থাকে জানিয়ে আবু হাসান বলেন, ‘তারা আমাদের মাথায় আঘাত করে আর মুখে ছুড়ে মারতে থাকে গোবর ও ময়লা–আবর্জনা।’ এর মধ্যে একজন চোখে বাঁধা কাপড় খুলে দেয়। আবু হাসান বলেন, ‘এরপর আমার মুখের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, “আমাকে চিনতে পারছ না?” আমি উত্তর দিই, না। এটা শোনার পর আমার পুরো শরীরে আঘাত করতে থাকে। মাথা ও দুই পায়ে পেটায়। আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য পেছন থেকে পিঠেও লাথি মারে।’
এরপর একজন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। খালেদ জানান, বেশির ভাগ প্রশ্ন ছিল ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে। যেমন ‘তোর মায়ের নাম কী? তোর বোনের নাম কী? তোর প্রেমিকা কে? ইত্যাদি।’
তাঁদের যেভাবে অত্যাচার করা হয়েছে, তা অবর্ণনীয় বলে উল্লেখ করেন আবু হাসান। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের শরীরে প্রসাব করে, পানি ঢেলে দেয়। এরপর একজন একটি লাঠি নিয়ে আমার পায়ুপথে তা ঢোকানোর চেষ্টা করে। সর্বশক্তি দিয়েই এসব সহ্য করি।’
নির্যাতনের শিকার ওই দুই ফিলিস্তিনি জানান, এভাবে দিনভর নির্যাতনের পর ভবন থেকে বের করে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তখনো তাঁদের হাত ছিল বাঁধা। পরনেও ছিল শুধু অন্তর্বাস। এ সময় তাঁদের ছবি তোলা হয়। পরে সেসব ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সেসব ছবিতে তৃতীয় যে ফিলিস্তিনিকে দেখা যায়, তাঁর নাম মাজিদ (৩০)। মাজিদ ওয়াদি আস–সাইক নামের ওই গ্রামের বাসিন্দা। মাজিদ জানান, সেদিন সকাল ১০টার দিকে তাঁর গ্রামে ঢোকেন ইসরায়েলের সেনা ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই অভিযোগ তদন্ত করছে সামরিক পুলিশের (এমপি) তদন্ত শাখা। এ ঘটনায় জড়িত সেই সেনা ইউনিটের প্রধানকে সেনাবাহিনী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
মাজিদ বলেন, ‘আমি তখন বাড়িতে। তারা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে আসে। বিভিন্ন বাড়িতে ঢোকে লোকজনকে তুলে নেওয়ার জন্য। তবে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পালালেও আমি তাদের হাতে আটক হয়ে যাই। আমাকে ধরার পর রাইফেল ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। দড়ি দিয়ে হাত বাঁধে। তখন প্রচণ্ড গরম। আমার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। বারবার চেতনা হারাচ্ছিলাম।’
দিনভর নির্যাতনের পরে সেদিন সন্ধ্যায় আবু হাসান, মোহাম্মদ খালেদ ও মাজিদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার সময় তাঁদের হাঁটা-চলার মতো অবস্থাও ছিল না। এ জন্য ফিলিস্তিনের একটি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাদের রামাল্লার একটি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় সেনা ও বসতি স্থাপনকারীরা।
সেদিন সারা রাত হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি ফেরেন আবু হাসান। তবে খালেদকে হাসপাতালে থাকতে হয় আড়াই দিনের বেশি। আর মাজিদ হাসপাতালে ছিলেন দুই দিন। আবু হাসান বলেন, ‘আমার সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরেছিল সেদিন। আমি এখনো একা ঠিকমতো দাঁড়াতে পারি না।’
গাজায় যুদ্ধ চলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্যদের বেশির ভাগই এখন ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্তে। এ কারণে পশ্চিম তীরে এখন যাদের মোতায়েন করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই রিজার্ভ সেনা (সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়া বেসামরিক নাগরিক, জরুরি প্রয়োজনে যাদেরকে তলব করা হয়)। এই রিজার্ভ সেনাদের বেশির ভাগ হচ্ছে পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী।
আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে, এই বসতি স্থাপনকারীদের কাছে আগে থেকে ভারী অস্ত্র ছিল। এর মধ্যে নতুন করে তাদের হাতে আরও অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী বেশির ভাগ বসতি স্থাপনকারী সঙ্গে অস্ত্র রাখতে পারেন। এই বসতি স্থাপনকারীরা এসব অস্ত্র দিয়ে যে বিভিন্ন সময়ে সহিংসতা ও বেআইনি কাজ করে এসেছে, ইতিহাসে তার বহু নজির রয়েছে।
তৃতীয় বিষয়টি হলো পশ্চিম তীরের মেষপালক ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও হুমকি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবার ইসরায়েলে সরকার গঠনের পর থেকে এ প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই সহিংসতা সুনামির গতিতে বেড়েই চলেছে।
ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে আগে থেকেই পার্থক্য করার মতো তেমন কিছু ছিল না। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তাদের আরও কাছাকাছি এনেছে। তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের আলাদা করা এখন বেশ কঠিন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই অভিযোগ তদন্ত করছে সামরিক পুলিশের (এমপি) তদন্ত শাখা। এ ঘটনায় জড়িত সেই সেনা ইউনিটের প্রধানকে সেনাবাহিনী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে শিন বেত। এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ইসরায়েলি পুলিশের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভাষান্তর: আল–আমিন সজীব