ইসরায়েলের ওপর মিসর ও সিরিয়ার আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে ১৯৭৩ সালে চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। গতকাল শনিবার ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বড় ধরনের হামলাকে কেন্দ্র করে ৫০ বছর পর আগের সে পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল হামাসের হামলাটিও ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। দিনটিও ছিল ইহুদিদের ছুটির দিন। ওই হামলার পর ইসরায়েলও গাজায় বিমান হামলা চালিয়েছে। স্থল অভিযানেরও পরিকল্পনা করছে তারা।
কিছুদিন ধরেই গাজা উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে দেখা গিয়েছিল। তবে ভাবা হচ্ছিল, গাজার শাসনে থাকা হামাস কিংবা ইসরায়েল কেউই চায় না উত্তেজনা আরও বাড়ুক। সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে গতকাল শনিবার হঠাৎ ইসরায়েল অভিমুখে বড় ধরনের অভিযান শুরু করে হামাস। তারা একের পর এক রকেট ছুড়তে থাকে। কিছু রকেট জেরুজালেম ও তেল আবিবের মতো দূরবর্তী শহরগুলোতেও পৌঁছাতে পেরেছে।
হামাসের হামলা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত হলেও তা ছিল সুপরিকল্পিত। শনিবার রকেট হামলা চালানোর পাশাপাশি স্থলপথ, সমুদ্রপথ ও আকাশপথ ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে পড়েন। তাঁরা কয়েক ঘণ্টা ধরে ইসরায়েলি শহর ও সেনাচৌকি অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাঁদের অভিযানে বেশ কিছুসংখ্যক ইসরায়েলি নিহত হন। কিছুসংখ্যক সামরিক-বেসামরিক ইসরায়েলি নাগরিককে তাঁরা জিম্মি করে গাজায় নিয়ে গেছেন। তবে এ সংখ্যা ঠিক কত, তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।
সাধারণ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা আতঙ্কে
গতকাল শনিবার ইহুদিদের ছুটির দিন ছিল। শনিবার রাতে গাজার কাছের এলাকাগুলোতে উৎসবে ব্যস্ত থাকা হাজারো ইসরায়েলিও গোলাগুলির কবলে পড়েছিলেন। ফুটেজে দেখা গেছে, তাঁরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে ছুটে বেড়াচ্ছেন। গিলি ইয়োসকোভিচ বিবিসিকে বলেন, ভারী অস্ত্রশস্ত্রবাহী হামাস যোদ্ধাদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি গাছের ফাঁকে লুকিয়ে ছিলেন। ইয়োসকোভিচ আরও বলেন, ‘তারা এক গাছ থেকে আরেক গাছের কাছে যাচ্ছিল এবং সব জায়গায় গুলি ছুড়ছিল। দুই পাশ থেকে গুলি চলছিল। আমি দেখলাম, চারপাশে মানুষ মরে পড়ে আছে।’
কিব্বুৎজ বিরির বাসিন্দা এলা ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হা ইয়োমকে বলেন, রকেট হামলার আগে আগে সতর্কসংকেত বাজানো হলে তাঁর বাবা বোমা থেকে সুরক্ষিত একটি আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গিয়েছিলেন। এখন তিনি তাঁর বাবাকে নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
এলা বলেন, ‘তিনি (বাবা) আমাকে লিখে পাঠিয়েছেন যে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে সন্ত্রাসীরা ঢুকে পড়েছে। টেলিগ্রাম অ্যাপে আমি তার ছবি দেখেছি। সেখানে দেখা গেছে, তিনি গাজায় আছেন। আমি এখনো গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’
ইসরায়েলিদের অনেকের অভিযোগ, তাঁদের দেশের নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত সহযোগিতা করতে পারেনি। হামাসের বিভিন্ন মাধ্যমগুলোতে শেয়ার হওয়া ফুটেজে দেখা গেছে, সেনাচৌকি ও একটি ট্যাংকে থাকা সেনাদের আটক ও হত্যা করা হয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের রকেট হামলার পর শুরুতে গাজায় উদ্যাপন হতে দেখা যায়। গাজা সিটিতে বসবাসকারী এক তরুণ বিবিসিকে বলেন, ‘আল–আকসায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বদলা হিসেবে হামাস এখন পর্যন্ত যা করেছে, তার জন্য আমি খুশি।’
আল–আকসা মসজিদ মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ইহুদিদের কাছেও পবিত্র স্থান। ইহুদিরা এটিকে টেম্পল মাউন্ট বলে ডেকে থাকে।
ইসরায়েলি বাহিনীর পাল্টা হামলার আশঙ্কায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো এক ফিলিস্তিনি বিবিসিকে বলেছেন, এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে তিনি আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তায় আছি। এমনিতেই ২০২১ সালে যুদ্ধ চলার সময় শোরুক টাওয়ারে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আমাদের পারিবারিক দোকানটি ধ্বংস হয়ে গেছে। এবার হামাস আরও বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সুতরাং এর জবাবে ইসরায়েলও আরও বড় পদক্ষেপ নেবে।’
ইসরায়েলের বিমান হামলার পর ফিলিস্তিনি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছেন।
এরপর কী হতে যাচ্ছে
গাজা উপত্যকায় প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস। পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের এক বছর পর ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ইসরায়েল ও মিসর গাজায় অবরুদ্ধ অবস্থা আরও জোরদার করে। তবে গাজায় বেকারত্ব প্রায় ৫০ শতাংশ।
২০২১ সালে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতের পর মিসর, কাতার ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের পরোক্ষ আলোচনা হয়। তখন হাজারো গাজাবাসীকে ইসরায়েলে কাজ করার অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হয়। আরও কিছু কড়াকড়িও শিথিল করার সিদ্ধান্ত হয়।
গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল সীমান্তে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গাজার কর্মীদের জন্য দুই সপ্তাহ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় আবারও দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়।
গতকাল শনিবার ইসরায়েল অভিমুখে রকেট হামলার শুরুতে হামাসের সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনিদের প্রতি আহ্বান জানান, তাঁরা যেন ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপে শামিল হয়। তবে এখন বড় প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম কিংবা ওই অঞ্চলের অন্য এলাকায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবেন কি না।
নিঃসন্দেহে ইসরায়েল একটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছে এবং বিভিন্ন দিক থেকে এ যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
আরও বাজে পরিস্থিতি হবে তখন, যখন লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের সেনাদের শক্তিসামর্থ্য বাড়ানোর আদেশ দিয়েছে। গাজায় বিমান হামলার পাশাপাশি সেখানে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা চলছে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।
তবে হামাস ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক নাগরিকদের জিম্মি করেছে। তাঁদের মানব ঢাল ও দর-কষাকষির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের আশা করছে হামাস। এটি একটি বড় জটিলতার বিষয়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় আছি। ব্যাপক হামলা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে গাজা উপত্যকার আশপাশের এলাকাগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতির ব্যাপারে খুব নিবিড় ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করব।’
পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনাকে সামনে রেখে নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করছেন, কেন তাঁরা আগে থেকে হামাসের হামলার আভাস পাননি। এত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে তাঁরা কীভাবে ব্যর্থ হলেন।