যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর লেবাননের টায়ার নগরে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন স্থানীয় লোকজন
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর লেবাননের টায়ার নগরে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন স্থানীয় লোকজন

ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি: মধ্যপ্রাচ্যের জন্য কতটা স্বস্তির

বাস্তুচ্যুত লোকজন ভোরের আগেই তাঁদের গাড়ি গুছিয়ে নিয়েছেন। এবার তাঁরা বাড়িতে ফিরবেন। বাড়ি বলতে, যা কিছু অবশিষ্ট আছে। ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে লেবাননে ১০ লাখের বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষ হয়েছেন নিহত। হাজারো মানুষ আহত। কয়েক হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে ইসরায়েলের কেউ কেউ মনে করছেন, লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর আরেকটু বেশি ক্ষতি করার সুযোগ হারিয়েছেন তাঁরা।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেশটির উত্তরের পৌরসভাগুলোর প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। প্রায় ৬০ হাজার বেসামরিক নাগরিককে আরও দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার কারণে সেগুলো এখন ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েলের ইনেৎ ওয়েবসাইটের খবরে বলা হয়, বৈঠকে সবাই ক্ষুব্ধ ছিলেন, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ইসরায়েল লেবাননে তার শত্রুর ওপর থেকে চাপ তুলে নিচ্ছে ও বেসামরিক লোকদের (ইসরায়েলি) ঘরে ফেরার কোনো পরিকল্পনা দিচ্ছে না।

একটি পত্রিকার কলামে কিরয়াত শমোনার মেয়র বলেছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া নিয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে। দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের একটি বাফার জোন তৈরির দাবি করছেন তিনি।

যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েলের টেলিভিশন স্টেশন ‘চ্যানেল ১২ নিউজ’ একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। যুদ্ধবিরতির পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান করা লোকজন জরিপে অংশ নিয়েছেন। অর্ধেক অংশগ্রহণকারী বিশ্বাস করেন, হিজবুল্লাহ এখনো পরাজিত হয়নি। ৩০ শতাংশ বলেছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে পড়বে।

এএফপির খবরে বলা হয়েছে, লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে গত বুধবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। তবে লেবানন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সেনা প্রত্যাহার করবে না ইসরায়েল। যদিও ৬০ দিনের মধ্যে তাদের অবশ্যই সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে, এমন শর্ত রয়েছে।

লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানের সময় অনেক ভবন বিধ্বস্ত হয়

গত সেপ্টেম্বরে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (লেবাননে যুদ্ধবিরতি নিয়ে) একটি চুক্তি হয়েই যাবে বলে মনে হচ্ছিল। এখন যে চুক্তি কার্যকর হয়েছে, অনেকটা তেমনই একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কূটনীতিকেরা।

নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন ১৭০১–এর প্রবিধান মেনে ওই যুদ্ধবিরতি চুক্তির খসড়া তৈরি করা হয়। যুদ্ধের সব পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ইচ্ছার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মঞ্চে গিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। তিনি ইসরায়েলের অভিযানে কোনো ধরনের বিরতি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
নিউইয়র্কে হোটেলে বসেই নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহর সে সময়ের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ ও তাঁর শীর্ষস্থানীয় সহযোগীদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। নেতানিয়াহুর সরকারি আলোকচিত্রী ওই মুহূর্তে ছবি তুলেছিলেন। নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে সেসব ছবি প্রকাশ করা হয়।

নেতানিয়াহু: রসদপত্রের মজুত আবার পূরণের সময়

গাজা ও অধিকৃত বাকি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের তুলনায় লেবাননে ইসরায়েলের লক্ষ্য সীমিত। তারা হিজবুল্লাহকে তাদের উত্তরের সীমান্ত থেকে দূরে রাখতে চায়, যেন উত্তরের সীমান্তবর্তী শহরের বাসিন্দারা বাড়িঘরে ফিরে আসতে পারেন।

ইসরায়েল যদি মনে করে হিজবুল্লাহ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে দেশটি তাদের বিরুদ্ধে আবার সামরিক অভিযান শুরু করতে পারবে। রেকর্ড করা একটি বিবৃতিতে নেতানিয়াহু এ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির সময় কেন হয়েছে, সে ব্যাখ্যাও দেন তিনি। বলেন, ‘ইসরায়েল বৈরুতের মাটি কাঁপিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের বাহিনীকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে এবং আমাদের রসদপত্র পূরণ করার সুযোগ পাওয়া গেছে।’

নেতানিয়াহু আরও বলেন, ইসরায়েল গাজা ও লেবাননের মধ্যকার যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে। গত বছর ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল আগ্রাসন শুরু করার পরদিন হাসান নাসরুল্লাহ দেশটির উত্তরাঞ্চলে হামলার নির্দেশ দেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত হামলা অব্যাহত থাকবে।
এখন গাজায় হামাস আরও বেশি চাপে থাকবে বলে মনে করেন নেতানিয়াহু। ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা, গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ আরও বাড়বে।

কেন ইরান যুদ্ধবিরতি চায়

হিজবুল্লাহর বেঁচে থাকা নেতাদের মতো ইরানে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরাও একটি যুদ্ধবিরতি চান। নিজেদের ‘ক্ষতে মলম’ লাগাতে হিজবুল্লাহর একটি বিরতি প্রয়োজন। ইরানের প্রয়োজন ভূকৌশলগত রক্তপাত বন্ধ করা। ইরানের প্রতিরোধ অক্ষও (মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নেতৃত্বাধীন অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক ও সামরিক জোট) এখন শত্রুপক্ষের হামলা প্রতিরোধ করা বা সংঘাতে ব্যস্ত নয়।

আবার নাসরুল্লাহ গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। কিন্তু এতেও তেহরানের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ হয়নি।

ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করতে হিজবুল্লাহ গড়ে তুলেছিল দুজনকে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, শুধু লেবানন থেকে নয়; বরং ইরান থেকেও হামলা চালিয়ে যাওয়ার। দুজনই গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। তাঁদের একজন ছিলেন কাসেম সোলাইমানি। তিনি ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাগদাদ বিমানবন্দরে ড্রোন হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে হত্যা করে।

হোয়াইট হাউসে নিজের প্রথম মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

অন্যজন হলেন হাসান নাসরুল্লাহ। বৈরুতে বিমান হামলা চালিয়ে সম্প্রতি ইসরায়েল তাঁকে হত্যা করেছে।

এবার হিজবুল্লাহ ও ইরান যেভাবে পিছিয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে, সেটি প্রায় ২০ বছর আগে ২০০৬ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের পিছিয়ে যাওয়ার কৌশলের সঙ্গে অনেকটা মিলে গেছে।

তবে ৭ অক্টোবরের হামলার ফলে কিছু গভীর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এর একটি, যুদ্ধের ব্যাপারে ইসরায়েলের অনড় অবস্থান। যুদ্ধ শুরু করার পর ইসরায়েল এ নিয়ে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ মেনে না নেওয়ার দৃঢ় সংকল্পে অটল আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাওয়া ও তাদের অস্ত্র ব্যবহার করা নিয়ে প্রায় কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেনি।

ইসরায়েল কীভাবে বদলে গেছে সেটা বুঝতে পারেননি নাসরুল্লাহ ও ইরানের নেতারা। তাঁরা ইসরায়েলের ওপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এবং প্রায় এক বছর এ কাজে সফলও হয়েছেন।

লেবাননে গত সেপ্টেম্বর মাসে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করেছিল ইসরায়েল

এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর সবাইকে চমকে দিয়ে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে ইসরায়েল। এর আগে দেশটির গোয়েন্দারা হিজবুল্লাহর কেনা কয়েক হাজার পেজারের (যোগাযোগের ছোট যন্ত্র) ভেতর গোপনে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর সেগুলোই একযোগে বিস্ফোরিত হয়। সাময়িকভাবে হলেও ভারসাম্যহীন অবস্থায় পড়ে হিজবুল্লাহ।

ইরানের কাছ থেকে পাওয়া শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলকে পাল্টা হামলা করার আগেই হিজবুল্লাহর ওপর আরও বড় আঘাত নেমে আসে। ইসরায়েল ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে নাসরুল্লাহ ও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীদের হত্যা করে। ধ্বংস করে অস্ত্রশস্ত্রের কিছু গুদামও। এর পরপরই ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করে। ধ্বংস করে দেয় সীমান্তবর্তী গ্রাম ও হিজবুল্লাহর সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক।

ট্রাম্প, গাজা ও ভবিষ্যৎ

লেবাননে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার অর্থ এ নয় যে এখন ফিলিস্তিনের গাজায়ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে। এ উপত্যকা তাদের কাছে ভিন্ন। গাজাযুদ্ধ ইসরায়েলের জন্য তার সীমান্ত নিরাপদ করা ও জিম্মিদের মুক্ত করার চেয়ে আরও বেশি কিছু।

গাজা ইসরায়েলের কাছে প্রতিশোধ নেওয়ারও স্থান। এ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও তাঁর সরকারের ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়।

এদিকে লেবাননের এ যুদ্ধবিরতিও ভঙ্গুর প্রকৃতির। এ চুক্তির মেয়াদ ৬০ দিন। তত দিনে ওভাল অফিসে ফিরে আসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি লেবাননে যুদ্ধবিরতি চান। তবে সেই যুদ্ধবিরতি কেমন হবে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
এ অঞ্চল নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছে মধ্যপ্রাচ্য।

নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকার, সেই সঙ্গে বেশির ভাগ ইসরায়েলি বিশ্বাস করেন, সামরিকভাবে জিততে চাইলে তাঁদের শত্রুদের ওপর চাপ বজায় রেখে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। সে অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে নেতানিয়াহু সক্রিয়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রও অবাধে তাঁকে তা করতে দিচ্ছে। তাই ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর মধ্যকার এ ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান নয়, সাময়িক স্বস্তিমাত্র।