ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। যুগের পর যুগ সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ যোদ্ধা—সবাই দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সংগঠনটির বিরুদ্ধে বড় ধরনের আঘাতও এসেছে অনেক।
অতিসম্প্রতি ইসরায়েলি হামলায় হামাসপ্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হন। আগেও এ সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে করুণ পরিণতির শিকার হয়েছেন। তাই বলে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা সংগঠনটির কার্যক্রম থেমে যায়নি।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক, হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কার ভাগ্যে কী ঘটেছে-
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইতিহাসে দেশটিতে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ধরা হয় সিনওয়ারকে। হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন। ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় ধরে নিয়ে যান হামাসযোদ্ধারা। সিনওয়ার ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় ছিলেন।
সিনওয়ার গাজায় থাকতেন। সেখানে থেকে হামাসকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত জুলাইয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর সিনওয়ার হামাসের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন।
১৯৬২ সালে গাজায় জন্ম সিনওয়ারের। অল্প বয়সেই হামাসের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। হামাসের গোয়েন্দা শাখার শুরু সিনওয়ারের হাত ধরেই। তিনবার ইসরায়েলিদের হাতে আটক হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে যখন তৃতীয় দফায় আটক হন, তখন ইসরায়েল তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে হামাসের হাতে পাঁচ বছরের বেশি সময় আটক থাকা ইসরায়েলি সেনার মুক্তির বিনিময়ে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি-আরব বন্দীদের মুক্তি দেয় ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে সিনওয়ার ছিলেন।
ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে হামাসে নিজের পুরোনো অবস্থানে ফেরেন সিনওয়ার। ২০১৭ সালে তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হন। এর আগে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সিনওয়ারকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের’ কালো তালিকাভুক্ত করে।
১৬ অক্টোবর গাজার রাফায় সিনওয়ারকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসমাইল হানিয়া ছিলেন হামাসের আরেক প্রধান। সংগঠনের সব শাখার শীর্ষ নেতা ছিলেন তিনি। গত ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে গুপ্ত হামলায় তিনি নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডে ইরান ও হামাস ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।
গত শতকের আশির দশকের শেষভাগ থেকেই হামাসের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন হানিয়া। ১৯৮৯ সালে ফিলিস্তিনি আন্দোলন দমনকালে ইসরায়েল তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। ১৯৯২ সালে আরও কয়েকজন হামাস নেতার সঙ্গে তাঁকেও ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ নির্বাসনে পাঠানো হয়।
এ ঘটনার বছরখানেক পর গাজায় ফেরেন হানিয়া। ১৯৯৭ সালে হামাসের তাত্ত্বিক নেতার দপ্তরের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ফিলিস্তিনের সাধারণ নির্বাচনে হামাস সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ায় ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হানিয়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন।
তবে সপ্তাহব্যাপী সংঘাতের পর আব্বাসের ফাতাহ পার্টিকে গাজা উপত্যকা থেকে হটিয়ে দিলে কপাল পোড়ে হানিয়ার। ক্ষমতা নেওয়ার বছরখানেকের মাথায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট আব্বাস।
২০১৭ সালে এসে হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নির্বাচিত হন ইসমাইল হানিয়া। পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালে হানিয়ার নাম সন্ত্রাসী তালিকায় যুক্ত করে ওয়াশিংটন। কয়েক বছর ধরে হানিয়া কাতারে বসবাস করছিলেন।
হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ দেইফ। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে চালানো নজিরবিহীন হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে ধরা হয় তাঁকে।
ইসরায়েলি সেনাদের আটক করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেইফ আল-কাসাম ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারাগারে পাঠায়।
মুক্ত হওয়ার পর গাজাজুড়ে হামাসের সুড়ঙ্গ (টানেল) নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় প্রকৌশলীদের সহায়তা করেন দেইফ। এসব টানেল ব্যবহার করে গাজা থেকে ইসরায়েলে ঢোকার সুযোগ রাখা হয়। ইসরায়েলের অন্যতম ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
২০০০ সালে আবারও আটক হন দেইফ। কিন্তু ফিলিস্তিনি দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় মুক্ত হন। ২০০২ সালে দেইফকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল। প্রাণে বাঁচলেও এক চোখ হারান তিনি। ইসরায়েল জানায়, দেইফ এক পা ও এক হাত হারিয়েছিলেন। কথা বলতেও সমস্যা হতো তাঁর।
গাজায় ২০১৪ সালে দেইফকে ইসরায়েলের আরেক দফা হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে এবার দেইফের স্ত্রী ও দুই সন্তান নিহত হন। তবে গত জুলাইয়ে গাজার খান ইউনিসে বিমান হামলায় দেইফ নিহত হয়েছেন বলে ইসরায়েল জানিয়েছে।
আল-কাসাম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন মারওয়ান ইসা। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনিও। অনেক বছর ধরে ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় মারওয়ানের নাম ছিল। ২০০৬ সালে হত্যাচেষ্টার একটি ঘটনায় বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন তিনি।
প্রথম ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েলের হাতে আটক হয়েছিলেন মারওয়ান। হামাসের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে আরেক দফা আটক হলেও ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হলে কারামুক্ত হন মারওয়ান।
২০১৪ ও ২০২১ সালে, দুই দফায় গাজায় মারওয়ানের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেয় ইসরায়েলি বিমান। হত্যা করা হয় তাঁর ভাইকে। ইসরায়েল বলেছে, গাজার মধ্যাঞ্চলে একটি শরণার্থীশিবিরের নিচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় এ বছরের মার্চে বিমান হামলা চালিয়ে মারওয়ানকে হত্যা করা হয়।
খালেদ মেশালের জন্ম পশ্চিম তীরে, ১৯৫৬ সালে। তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বলে মনে করা হয়।
জর্ডানে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরাসরি নির্দেশে মেশালকে হত্যার দায়িত্ব পায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। হত্যার জন্য কানাডীয় পর্যটক সেজে জর্ডানে যান মোসাদ সদস্যরা।
খালেদ মেশালকে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু জর্ডানের কর্তৃপক্ষ গোপন এ হত্যাচেষ্টা ধরে ফেলে। গ্রেপ্তার হন মোসাদের দুই গোয়েন্দা।
মেশাল কাতারে চলে আসেন। সেখানেই বসবাস করছিলেন। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো গাজায় যান মেশাল। ওই সময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও হাজারো গাজাবাসী তাঁকে বরণ করে নেন।
২০১৭ সালে ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হওয়ার আগে এ পদে ছিলেন খালেদ মেশাল। আর হানিয়া পদে বসার পর থেকে মেশাল বিদেশে সংগঠনের রাজনৈতিক শাখার প্রধানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বর্তমানে কাতারে স্বেচ্ছানির্বাসনে রয়েছেন তিনি।
মাহমুদ জাহারের জন্ম গাজায়, ১৯৪৫ সালে। বাবা ফিলিস্তিনি, মা মিসরীয়। হামাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন ধরা হয় তাঁকে। তিনি সংগঠনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশ ছিলেন।
গাজায় শিক্ষাজীবনের সূচনা জাহারের। পরে মিসরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর গাজা ও খান ইউনিসে চিকিৎসক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
১৯৮৮ সালে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দিজীবন শুরু হয় জাহারের। ১৯৯২ সালে ইসরায়েল সরকার যে কয়জন হামাস নেতাকে সীমান্ত এলাকায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে জাহারও ছিলেন।
২০০৬ সালের নির্বাচনে জিতে ইসমাইল হানিয়া যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান, তখন প্রভাবশালী নেতা জাহারকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। বছরখানেক ওই সরকার টিকে ছিল।
এর আগে ২০০৩ সালে জাহারকে হত্যার চেষ্টা করে ইসরায়েল। বিমান থেকে গাজায় তাঁর বাসভবনে বোমা ফেলা হয়। সামান্য আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তবে নিহত হন জাহারের বড় ছেলে খালেদ।
জাহারের দ্বিতীয় ছেলে হোসাম হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডের সদস্য ছিলেন। ২০০৮ সালে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন জাহারপুত্র হোসাম। তবে জাহার এখন কোথায় আছেন, তা কেউ জানে না।
এ ছাড়া আল-জাজিরার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলবিরোধী সংগঠন হামাসের আরও যেসব নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন-
জানুয়ারি, ১৯৯৬: গাজায় এক হামলায় নিহত হন হামাসের সামরিক শাখার নেতা ইয়াহিয়া আয়াশ। ইসরায়েল ওই হামলা চালিয়েছিল।
মার্চ, ২০০৪: হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন গাজায় নিহত হন। ওই হামলার পেছনেও দায়ী ছিল ইসরায়েল।
এপ্রিল, ২০০৪: আহমেদ ইয়াসিনের উত্তরসূরি ও হামাসের সহপ্রতিষ্ঠাতা আবদেল আজিজ আল-রানতিসি গাজায় নিহত হন। তিনি মারা যান ইসরায়েলি হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে।
জানুয়ারি, ২০২৪: হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সালেহ আল-অরোওরি লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হন।