ভূমিকম্প কেন হয়, এ সময়ে করণীয় কী

ভূমিকম্প–দুর্গত সিরিয়ার ইদলিবে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রের জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে এক শিশু। আজ মঙ্গলবার তোলা
ছবি: রয়টার্স

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন, নিহত মানুষের সংখ্যা ২০ হাজারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

গতকাল সোমবার তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার গভীরে ছিল এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। ভূমিকম্পের পর অর্ধশতাধিক পরাঘাত (বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট ভূমিকম্প) হয়।

ভূমিকম্প যে কারণে হয়

অনেক আগে পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগে কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত বলে ধীরে ধীরে তারা আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট।

টেকটোনিক প্লেটগুলো একে–অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে থাকে। কোনো কারণে এগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গ শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর তখনো যদি যথেষ্ট শক্তি থাকে, তাহলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই মূলত ভূমিকম্প।

বিবিসি ও আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক ফল্ট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে থাকা ফাটলকে ফল্ট লাইন বলা হয়। তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টের অবস্থান অ্যারাবিয়ান প্লেট ও আনাতোলিয়ান প্লেটের মাঝে। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে বহু আগে থেকেই খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সতর্ক করেছিলেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।

গতকালের ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার ফল্ট লাইন ভেঙে গেছে। এ কারণেই সৃষ্ট ভূমিকম্পটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আর এই ফল্টের কাছাকাছি থাকা ভবনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রায় ৮৪ বছর পর গতকাল তুরস্কে আবারও এই ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূকম্পনবিদ স্টিফেন হিকস বলেন, এর আগে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল।

ভূমিকম্প হলে যা করতে হবে

আবহাওয়াবিদ মো. মমিনুল ইসলাম প্রথম আলোতে এক লেখায় জানিয়েছিলেন, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া খুব জটিল বিষয়। কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্পকে সরাসরি নির্ণয় করা যায় না। তবে গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য পূর্বাভাস ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ণয় করা যায়, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধে সহায়তা করে। ভূমিকম্পবিষয়ক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।

ভূমিকম্পে ভবনের নিচে চাপা পড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। তাই সম্ভাব্য ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।

ভূমিকম্পের আগে যা করতে হবে

*বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন বন্ধ করার নিয়ম পরিবারের সবার জেনে রাখতে হবে।
*ঘরের ওপরের তাকে ভারী জিনিসপত্র না রাখা, পরিবারের সব সদস্যের জন্য হেলমেট
রাখতে হবে।

*পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের জন্য বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হবে।

ভূমিকম্প হলে দ্রুত যা করতে হবে

*ধীরস্থির ও শান্ত থাকতে হবে, বাড়ির বাইরে থাকলে ঘরে না ঢোকাই ভালো।
*একতলা ভবন হলে দৌড়ে বাইরে চলে যেতে হবে। বহুতল ভবনের ভেতরে
থাকলে টেবিল বা খাটের নিচে যেতে হবে; কাচের জিনিস থেকে দূরে থাকতে হবে। লিফট ব্যবহার করা যাবে না।

*উঁচু ভবনের জানালা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামার চেষ্টা করা যাবে না। ভূমি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে এমন উঁচু ভূমি থেকে দূরে থাকতে হবে।

*ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

ভূমিকম্পের পর করণীয়

*ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে ধীরস্থির ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

*রেডিও টেলিভিশন থেকে জরুরি নির্দেশা শুনে তা মেনে চলতে হবে।

*বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন লাইনে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, পরীক্ষা করে প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

*সরকারি সংস্থাগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করতে হবে।
*সম্ভব হলে উদ্ধারকাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে।

তুরস্কে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরের পর আর ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি। এ কারণে দেশটির এমন দুর্যোগ মোকাবিলা ও পূর্বপ্রস্তুতির ঘাটতি থাকতে পারে। এ কারণে ভূমিকম্প বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের পূর্বপ্রস্তুতি থাকা আবশ্যক।

ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও ত্রাণ কর্মসূচি নিশ্চিত করতে হবে। উদ্ধার কর্মসূচির অভাবে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে। পূর্বপ্রস্তুতি, দক্ষ প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক উদ্ধার কর্মকাণ্ডের মূল চাবি। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ, ওষুধ, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।