ইসরায়েলের দিকে ‘তাক করা আছে’ হিজবুল্লাহর দেড় লাখ রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র

ইসরায়েলের কারিশ গ্যাসক্ষেত্রের দিকে উড়ে যাচ্ছে হিজবুল্লাহর একটি ড্রোন। গত জুলাইয়ে ধারণ করা ভিডিও থেকে ছবিটি নেওয়া
ছবি: এএফপি

লেবাননের ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস রকেট ছোড়ার পর হিজবুল্লাহও লেবানন সীমান্তবর্তী ইসরায়েলে হামলা চালায়। এরপর নতুন করে আলোচনায় আসে তারা।

বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে প্রায় দেড় লাখ রকেট ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। এসব অস্ত্র দিয়ে যেকোনো সময় ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে পারে তারা। সম্প্রতি এক বিশ্লেষণে এ তথ্য জানা গেছে।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস এক সংবাদ সম্মেলনে হিজবুল্লাহকে নিয়ে একটি মূল্যায়ন করেছিলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকও উপস্থিত ছিলেন। রবার্ট গেটস বলেছিলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় হিজবুল্লাহর কাছে অনেক বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’

হিজবুল্লাহর রয়েছে প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত বাহিনী

লেবাননের এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে থাকে। রকেটসহ বিভিন্ন যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করে তারা। এসব কাজে ইরান তাদের সহায়তা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদকে সহযোগিতা করার সময় অর্জিত অভিজ্ঞতাও কাজে লাগিয়েছে হিজবুল্লাহ।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, হিজবুল্লাহর কাছে দেড় লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। অধিকাংশই কয়েক কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। তবে একাধিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, তাদের কাছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা লেবানন থেকে কয়েক শ কিলোমিটার দূরে হামলা করতে সক্ষম।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নেই, এমন সংগঠনগুলোর মধ্যে হিজবুল্লাহকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রসজ্জিত বলে বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালে এ গবেষণা করা হয়। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর কাছে বিপুল পরিমাণ ‘ডাম্ব’ রকেট রয়েছে। পাশাপাশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান-বিধ্বংসী, ট্যাংক-বিধ্বংসী ও জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে তাদের ভান্ডারে।

ওই গবেষক দলের অন্যতম সদস্য শান শেখ। চলতি সপ্তাহে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর হস্তক্ষেপ নিয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘সিরিয়া, ইরান কিংবা রাশিয়ার কাছ থেকে হিজবুল্লাহ আরও উন্নত ও স্ট্যান্ডঅফ ক্ষেপণাস্ত্র পেতে পারে, যা উদ্বেগজনক।’ যেকোনো স্থান থেকে পরিচয় গোপন রেখে দূরবর্তী লক্ষ্যে হামলা চালাতে সক্ষম স্ট্যান্ডঅফ ক্ষেপণাস্ত্র।

তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সম্প্রতি একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর কাছে প্রায় ৪০ হাজার স্বল্পপাল্লার রকেট, ইরানের তৈরি ৮০ হাজার মধ্যপাল্লার ফজর-৩ ও ফজর-৫ রকেট এবং ৩০ হাজার দূরপাল্লার জেলজেল রকেট ও ফাতেহ-১১০ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, সিরিয়া থেকে স্বল্প পরিমাণ স্কাড-ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে হিজবুল্লাহ। এ ছাড়া কয়েক শ ফাতেহ-১১০ ক্ষেপণাস্ত্রও পেয়েছে তারা। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ৫০০ কেজি ওজনের বোমা বহন করতে সক্ষম। জিপিএস প্রযুক্তিসংবলিত এ ক্ষেপণাস্ত্র নিখুঁতভাবে যেকোনো স্থানে হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম।
ইসরায়েলের সামরিক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমান করছে, যুদ্ধের প্রথম কয়েক দিনে কয়েক হাজার রকেট ছুড়তে পারে হিজবুল্লাহ। এরপর প্রতিদিন দেড় হাজার রকেট ছোড়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। ২০০৬ সালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ রকেট ছুড়েছিল সংগঠনটি।

বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদের ভান্ডার ছাড়াও হিজবুল্লাহর সংগ্রহে প্রচুর বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, যা হেলিকপ্টার ও নিচ দিয়ে যাওয়া বিমান ভূপাতিত করতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের আরেকটি বিশেষত্ব হলো, এটি নিক্ষেপকারীর অবস্থান গোপন রাখতে সক্ষম। ফলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে দ্রুতই যে কেউ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ

হিজবুল্লাহর কাছে রয়েছে ভারী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে আকাশের ২৪ কিলোমিটার ওপরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহর ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বেশ বিপদে ফেলে দিয়েছিল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে। তাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল। ট্যাংক-বিধ্বংসী ইউনিট রাশিয়ার করনেট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এটি মার্কিন জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্রের মতো। তুলনামূলক হালকা হওয়ায় অনেক দূর থেকে ট্যাংকে আঘাত হানতে পারে এটি।

২০১১ সাল থেকে সাঁজোয়া ট্যাংক ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এটি যেকোনো ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম। ২০১৪ সালে এই ট্যাংক সফলভাবে করনেট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করেছে।

ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি ২০ বছর ধরে নিজস্ব বিমানবাহিনী গড়ে তুলেছে হিজবুল্লাহ। এই বাহিনীর মূল ভিত্তি হলো চালকবিহীন ড্রোন। কিছু ড্রোন ইরানে তৈরি, আবার কিছু স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়েছে।

হিজবুল্লাহর রয়েছে একটি কমান্ডো ইউনিট, যেটি রেদওয়ান ফোর্স নামে পরিচিত। এই বাহিনী ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। দুই সপ্তাহ আগে হামাস যেভাবে দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা করেছিল, একইভাবে তারাও ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রাম ও শহর দখল নিতে পারে।

হিজবুল্লাহর প্রায় আড়াই হাজার সদস্য রয়েছেন, যাঁরা লেবানন ও ইরানে প্রশিক্ষিত। তাঁরা প্যারাগ্লাইডিং ও সমুদ্রপথে ঢুকে হামলা চালাতে সক্ষম। এ ছাড়া তাঁদের অনেকেরই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

২০১৮ সালে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি টানেলের সন্ধান পায় সামরিক বাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, এসব টানেল ব্যবহার করে ইসরায়েলে প্রবেশ করতেন হিজবুল্লাহ সদস্যরা। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে, টানেল ব্যবহার করে ইসরায়েলে হামলা চালানো সম্ভব।