গাজায় ইসরায়েলি সেনা-হামাস লড়াই

ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছাড়েন গাজার উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দা। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ জাতিসংঘ পরিচালিত একটি কেন্দ্র থেকে খাদ্যসহায়তা নিচ্ছেন। গতকাল গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকায়
ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় শুক্রবার রাতে ব্যাপক পরিসরে শুরু হওয়া ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযান গতকাল শনিবারও অব্যাহত ছিল। এ উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে ঢুকে পড়া দেশটির সেনাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।

এদিকে ইসরায়েলের বিরামহীন হামলায় গাজায় গত ২২ দিনে সাড়ে সাত হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

শুক্রবার রাতে ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে বিধ্বস্ত গাজায় স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে কার্যত গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া গাজা উপত্যকায় কী হচ্ছে, তার প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না।

তবে এক বিবৃতিতে গতকাল হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডস বলেছে, উত্তর গাজার বেইত হানুন ও পূর্বাঞ্চলীয় বুরেইজ এলাকায় অনুপ্রবেশকারী ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবেন তাঁরা।

অভিযানের ব্যাপারে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি গতকাল বলেন, তাঁদের পদাতিক বাহিনী এখনো গাজায় রয়েছে। তারা পরবর্তী অভিযানের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরিতে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত এই বাহিনীর কেউ হতাহত হননি। উত্তর গাজার বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন এই ইসরায়েলি কর্মকর্তা।

‘নিরাপদ এলাকায়’ হামলায় নিহত ৩৭৭

৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৭০৩ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি শিশু। গতকাল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে। মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

গতকাল এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা বলেন, ইসরায়েলের ব্যাপক বোমা হামলায় শুধু নিরাপদ ঘোষিত অঞ্চলেই আরও ৩৭৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জনের মতো। তাঁদের মধ্যে তিন শতাধিক সেনাও রয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করতে দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে জিম্মি করে রেখেছেন হামাস যোদ্ধারা। জিম্মিদের মধ্যে কয়েকজন পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বৈত নাগরিক।

‘মারা পড়বে হাজারো বেসামরিক মানুষ’

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নতুন ধাপে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। তিনি বলেছেন, চলমান সামরিক অভিযান গাজার মাটি কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে গ্যালান্ট বলেন, ‘আমরা স্থলভাগের ওপর ও নিচে আক্রমণ চালিয়েছি। আমরা সব জায়গায়, সর্বস্তরের সন্ত্রাসীকে লক্ষ্যবস্তু করেছি। সামরিক বাহিনীর প্রতি বার্তা স্পষ্ট—নতুন করে নির্দেশনা দেওয়ার আগপর্যন্ত এ অভিযান চলবে।’

এদিকে গাজায় স্থল অভিযান ও অব্যাহত বোমাবর্ষণের বিষয়ে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। তিনি বলেন, ‘আমি গাজায় বড় পরিসরে স্থল অভিযানের সম্ভাব্য বিপর্যয়কর পরিণতি ও আরও হাজারো বেসামরিক লোকের সম্ভাব্য প্রাণহানির বিষয়ে সতর্ক করছি।’

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে ইসরায়েল ও দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত জাতিসংঘ তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান নাভি পিল্লাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘কমিশন তদন্তে দেখতে পেয়েছে, ক্রমবর্ধমান হারে সামরিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ইসরায়েলের তৈরি করা আইনের প্রয়োগ ও গাজায় তাদের বারবার হামলার লক্ষ্য, দেশটির ৫৬ বছরের বেআইনি দখলদারত্ব বজায় রাখা।’

সতর্ক করেছে সৌদি আরব ও রাশিয়া

গাজায় চূড়ান্ত পর্যায়ের স্থল অভিযান শুরু করার বিষয়ে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে সৌদি আরব ও রাশিয়া। এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলের স্থল অভিযানে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

এক বিবৃতিতে গতকাল সৌদি আরব বলেছে, ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের এই নির্লজ্জ ও অন্যায্য লঙ্ঘন অব্যাহত রাখার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করা হচ্ছে।

আর গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে গতকাল রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ‘যদি গাজা উপত্যকাকে ধ্বংস ও সেখানকার ২০ লাখ বাসিন্দাকে বহিষ্কার করা হয়, তবে তা কয়েক শতাব্দীর জন্য না হলেও বহু দশক ধরে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।’

একই দিন গাজায় যুদ্ধবিরতি চেয়ে লন্ডনে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। এ দাবিতে আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনের উদ্যোগেও বিক্ষোভ হয়। সেখান থেকে কয়েক শ ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। গতকাল বড় বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। সমাবেশে ইসরায়েলকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।