ইরানের হামলার মূল্য চোকানোর অঙ্গীকার করেছে ইসরায়েল। চলতি মাসের শুরুর দিকে সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার পর প্রতিশোধ হিসেবে গত শনিবার দেশটিতে নজিরবিহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান।
তেহরানের হামলার পর সংযম দেখাতে ইসরায়েলের ওপর শুরু হয় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ। এ অবস্থায় ওই হামলার সম্ভাব্য জবাবের ধরন নিয়ে বিতর্ক করতে কয়েকবার বৈঠক করেছে ইসরায়েলি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা। ইতিমধ্যে ইসরায়েলি সেনাপ্রধান হারজি হালেভি বলেছেন, সামরিকভাবে ইরানকে জবাব দেওয়াটা নিশ্চিত।
তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসিও চুপ করে থাকেননি। যদি ইসরায়েল ইরানের মাটিতে সরাসরি সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাকে ‘ধ্বংসাত্মক ও কড়া জবাব’ দেওয়া হবে বলে গতকাল বুধবার হুমকি দিয়েছেন তিনি। এখন ইসরায়েল যদি হামলা করেই বসে, তবে ইরান নিজেকে কতটা কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পারবে, তা নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে।
কয়েক দশক ধরে ইরান অর্থনৈতিকভাবে ক্রমবর্ধমান হারে স্থানীয় সক্ষমতার ওপর জোর দিয়ে আসছে। দেশটির সামরিক খাতেও দেখা যাচ্ছে একই রকমের পদক্ষেপ নিতে।
নিজস্ব সক্ষমতায় নির্ভরশীলতার মনোভাবের এক বড় অংশের পেছনে রয়েছে প্রতিবেশী ইরাকের সঙ্গে ইরানের আট বছর ধরে চলা যুদ্ধের ঘটনাটি। ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে ১৯৮০ সালে ইরানে হামলা চালায় বাগদাদ। তাকে সামরিকভাবে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কিছু শক্তি।
ইরানের কাছে সর্বোচ্চ দূরপাল্লার যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তা স্থানীয়ভাবে তৈরি বাভার-৩৭৩। এক দশক ধরে উন্নয়নকাজ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১৯ সালে এটি সক্রিয় করা হয়। এর পর থেকে এটির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে।
এরই মধ্যে দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের কবলে পড়েছে ইরান। এতে তার আকাশপথের আধিপত্য এখন পর্যন্ত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দেশটির বিমানবাহিনীতে আছে জঙ্গি বিমান ও অন্য সমরাস্ত্র। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত এফ–৪ ও এফ–৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এগুলো আবার ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের আগের সময়কার। ইসলামি বিপ্লবে উৎখাত হন পশ্চিমা–সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলবি।
ইরান এখন রাশিয়া–নির্মিত সুখোই ও মিগ যুদ্ধবিমানের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। যুদ্ধবিমানগুলো সাবেক সোভিয়েত আমলের। অবশ্য ইরানের বিমানবাহিনী মার্কিন নকশায় সায়েকাহ ও কাওসারের মতো যুদ্ধবিমান তৈরি করছে। ইসরায়েলের মোতায়েন করা শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধবিমান এফ–৩৫–এর সঙ্গে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় না।
রাশিয়া–নির্মিত ২৪টি এসইউ–৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে কিছুকাল ধরে চলা সমঝোতা ইরানের বিমানবাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে উল্লেখযোগ্যভাবে। কিন্তু দেশটির শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এটি মিটিয়ে দেবে না।
ইরান উচ্চাভিলাষী ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি হাতে নিয়ে তার পুরোনো যুদ্ধবিমান বহরের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এর ধারাবাহিকতায় তেহরান বিশেষভাবে নজর দিয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদারে। এর বাইরে কিছু বিমানঘাঁটি, ক্ষেপণাস্ত্রের গুদাম ও পারমাণবিক স্থাপনা গহিন পার্বত্য অঞ্চলে গড়ে তুলছে তারা।
ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বাংকারবিধ্বংসী অস্ত্র থেকে এগুলো রক্ষা করাই এ পদক্ষেপের লক্ষ্য। ছয় মাস ধরে গাজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা বাংকারবিধ্বংসী বোমা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে ইসরায়েল।
ইরানের কাছে সর্বোচ্চ দূরপাল্লার যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তা স্থানীয়ভাবে তৈরি বাভার–৩৭৩। এক দশক ধরে উন্নয়নকাজ ও পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ২০১৯ সালে এটি সক্রিয় করা হয়। এর পর থেকে এটির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে উন্নত সংস্করণের বাভার–৩৭৩ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার প্রদর্শন করেন ইরানি কর্মকর্তারা। সে সময় তাঁরা বলেন, এর রাডার শনাক্তকরণ ব্যবস্থা ৩৫০ কিলোমিটার (২১৭ মাইল) থেকে ৪৫০ কিলোমিটারে (২৮০ মাইল) উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে আধুনিক ‘সায়াদ ৪বি’ ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করা হয়েছে দূরপাল্লার এ ব্যবস্থায়।
এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও স্টিলথ জঙ্গি বিমানসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারে। একসঙ্গে ৬০টি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) পর্যন্ত দূরের ছয়টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে তা প্রতিহত করা সম্ভব এ ব্যবস্থায়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রাশিয়া–নির্মিত ‘এস–৩০০’ ব্যবস্থার চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। এমনকি এটি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলোর একটি ‘এস–৪০০’–এর সঙ্গে তুলনীয়। ইরানের সামরিক মহড়ার বাইরে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে দ্য বাভার–৩৭৩–এর ব্যবহার হতে দেখা যায়নি। তবে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নিবিড় আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের একটি উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন সমর বিশেষজ্ঞরা।
এ ছাড়া রাশিয়ার সরবরাহ করা ‘টর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা’র বাইরে ইরান এস–৩০০ ব্যবস্থা ব্যবহার করে। ২০১৬ সালে ৬ বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের করা পারমাণবিক চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর এস–৩০০ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তেহরান।
এস–৩০০ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রথম ব্যবহার করা হয় সাবেক সোভিয়েত আমলে ১৯৭০–এর দশকের শেষ ভাগে। ১৫০ কিলোমিটারের (৯৩ মাইল) মধ্যে থাকা যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ধেয়ে আসা ক্রুজ ও ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার উপযোগী করে এটির নকশা করা হয়েছে। সেখানে টর স্বল্প থেকে মধ্যম পাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
স্থানীয়ভাবে তৈরি নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও চালু রেখেছে ইরান। সবচেয়ে দীর্ঘ পাল্লার ব্যবস্থার পেছনে স্তরে স্তরে সজ্জিত এ ব্যবস্থায় এক গুচ্ছ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
মধ্যম পাল্লার এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আরমান, ট্যাকটিক্যাল সায়াদ ও খোরদাদ–১৫। এগুলো বিভিন্ন উচ্চতায় ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) দূরের লক্ষ্যবস্তু থেকে ইরানের আকাশ রক্ষা করতে সক্ষম।
আরমান ২০২২ সালের নভেম্বরে উন্মোচন করা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে মোতায়েনের উপযোগী করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এটি।
মধ্যম পাল্লার এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পেছনে আছে আজারাখস, মাজিদ ও জুবিনের মতো স্বল্পপাল্লার ব্যবস্থা।
ইরানের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা উল্লম্বভাবে উৎক্ষেপণের উপযোগী। অধিক নমনীয়তা ও স্থান সংকুলানের সুবিধা থাকায় যুদ্ধজাহাজেও এগুলো মোতায়েন করা যায়।
চলতি বছর ইরানের আরও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্মোচনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে গত মার্চে দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা জানান।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) ও সেনাবাহিনীর কাছেও আছে নানা ধরনের ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর পাল্লা ২০০০ কিলোমিটার (১,২৪৩ মাইল) পর্যন্ত। এসব বাহিনীর আছে হামলাকারী ড্রোনও; যার কিছু শনিবার ইসরায়েলে হামলায় কাজে লাগানো হয়।
এক দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের সঙ্গে চলে আসা ছায়াযুদ্ধে ইসরায়েল ইরানি স্বার্থ লক্ষ্য করে অপ্রচলিত যুদ্ধের ওপর নির্ভর করছে বলে ধারণা করা হয়। ক্রমেই বেশি প্রকাশ্য হচ্ছে এ ছায়াযুদ্ধ।
ইসরায়েল একাধিকবার ইরানের বড় পারমাণবিক স্থাপনায় অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালিয়েছে। বোমা মেরে ও স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত মেশিনগান দিয়ে হত্যা করেছে পরমাণু বিজ্ঞানীদের। সামরিক স্থাপনাগুলোতেও চালিয়েছে গুপ্তহামলা। উড়িয়ে দিয়েছে গ্যাস পাইপলাইন।
ইরানের গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর, বিমানবন্দর ও পেট্রোল স্টেশনগুলোতে সক্রিয় জাতীয় নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন খাতে বড় পরিসরে একাধিক সাইবার হামলা চালানোর পেছনেও ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। ইরানও এসব হামলার অনেকগুলোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।
এসব হামলার প্রেক্ষাপটে কয়েক বছর ধরেই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়ে আসছে ইরান। সেই সঙ্গে রপ্ত করেছে হামলা ঠেকিয়ে দেওয়া ও মজবুত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কৌশলও।
ইরানে সাইবার হামলা ঠেকানোর দায়িত্বে রয়েছে দ্য ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর প্যাসিভ ডিফেন্স নামের সংস্থা। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বলছেন, সংস্থাটি দিনে হাজার হাজার না হলেও শত শত হামলা প্রতিহত করে থাকে।
গত কয়েক বছরে ইসরায়েলি স্বার্থের ওপরও বেশ কিছু সাইবার হামলা হওয়ার পেছনে ইরানের হ্যাকারদের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজ গত মঙ্গলবার এক খবরে বলেছে, এপ্রিলের শুরুতে ইরান–সংশ্লিষ্ট একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে; যেখানে আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের একটি দল এমন সব তথ্য প্রকাশ করছেন, যা ইসরায়েলের স্পর্শকাতর তথ্যভান্ডার ও ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক করে পাওয়া।