ম্যাকিয়াভেলি চরিত্রের আদর্শ শাসক মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড) ক্ষমতার যোগসূত্রগুলো ভালো বোঝেন। কাবুল থেকে তিউনিস নিজের রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে এনেছেন তিনি। ব্রাসেলস ও লন্ডন থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) নামমাত্র এক নেতার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমবেদনা জানানোর চেয়ে আরও বেশি কিছু পাঠিয়েছিলেন। তাঁর মন্ত্রিসভায় শীর্ষ পর্যায়ের একটি দল—ভাইস প্রেসিডেন্ট, সিআইএ পরিচালক, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমিরাত সফরে এবং দেশটির নতুন শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানের সঙ্গে হাত মেলাতে যান। তিনি এমবিজেড (মোহাম্মদ বিন জায়েদ) হিসেবেও পরিচিত। টাইম সাময়িকীর মতে, কিছু সময় ধরে তাঁকে বলা হচ্ছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। সম্ভবত তিনি তা-ই হতে চলেছেন।
আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান (৭৩) গত ১৩ মে মারা যান। তিনি ২০১৪ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পর থেকে তাঁকে আর জনসমক্ষে তেমন দেখা যায়নি।
শেখ খলিফার অসুস্থতার পর থেকে তাঁর সৎভাই যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি ক্ষুদ্র এই আরব দেশটিকে বিশ্বরাজনীতির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়ে যান। শেখ খলিফার মৃত্যুর পরদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৬১ বছর বয়সী শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ দায়িত্ব নেন।
ঐতিহ্যবাহী শক্তিগুলো পিছু হটায় এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে নেওয়ায় বদলে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র এমবিজেড। তিনি ইসরায়েলে সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত হুতি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন। কাবুল থেকে তিউনিস নিজের রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে এনেছেন তিনি। ব্রাসেলস ও লন্ডন থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।
জীবনযাপনের ধরনে আধা বেদুইন ছিলেন শেখ মোহাম্মদের বাবা জায়েদ। তবে ছেলেদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত। শেখ মোহাম্মদ যুক্তরাজ্যের স্যান্ডহার্স্টে ব্রিটিশ সামরিক একাডেমি থেকে ১৮ বছর বয়সে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি ব্রিটিশ প্রশিক্ষিত হেলিকপ্টার পাইলট; কড়া মনোভাবের একজন মানুষ।
শেখ মোহাম্মদের বয়স যখন ১৪ বছর, তাঁকে মরক্কোর একটি স্কুলে পাঠিয়েছিলেন বাবা জায়েদ। উদ্দেশ্য ছিল জীবনের কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে যাতে আতিথেয়তা না পান, সে জন্য পাসপোর্টে নামের শেষ অংশ বদলে দেওয়া হয়েছিল। মরক্কোয় অন্য সাধারণ একজন মানুষের মতো জীবন যাপন করেন এই যুবরাজ। নিজে রান্না করেই খেতেন। নিজের জামাকাপড় ধোয়ার কাজটাও নিজেই করতেন।
সামরিক কর্মকর্তা এমবিজেড আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা জায়েদের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী এবং যোগ্য সন্তান। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের বিশ্লেষক ব্রুস রিডেল বলেন, ‘তিনি ছিলেন স্বভাবজাত নেতৃত্বগুণের অধিকারী, উদ্যমী। তিনি দেশটির নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে কাছে টানার এবং নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করার একটা রাস্তা বের করে।’
এমবিজেডের বড় গুণ হলো তিনি কখনো এক পক্ষের ওপর নির্ভর করেন না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও সমানতালে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। পশ্চিমা চাপ সত্ত্বেও ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরেননি তিনি।
বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষতার জন্য আরব বিশ্বের নেতাদের মধ্যে এমবিজেডকে সবচেয়ে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও বিচক্ষণ মনে করা হয়। আরব বসন্তের সময় নিজের আবুধাবির ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি দৃঢ় হুঁশিয়ারিটি দিয়েছিলেন তিনি। যদিও এই বিদ্রোহের আঁচ তার ক্ষমতায় লাগেনি। ওবামার আত্মজীবনী অনুযায়ী, ওই আন্দোলনকে সমর্থন না দিতে বলেছিলেন এই আরব নেতা, যা কি না উপসাগরীয় রাজতন্ত্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এমবিজেডকে ‘সবচেয়ে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন’ উপসাগরীয় নেতা হিসেবেও উল্লেখ করেন ওবামা।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় আমিরাতের। এর অন্যতম কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমলে প্রতিশ্রুত সর্বাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি থেকে ওয়াশিংটনের সরে যাওয়া। যে প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল আমিরাত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এমবিজেডকে কৌশল প্রণয়নকারী হিসেবে অভিহিত করেন, যিনি আলাপের সময় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে আনেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি শুধু বর্তমান নিয়েই কথা বলেন না, কয়েক বছর ও কয়েক দশকেরও প্রসঙ্গ টানেন। ওই সময়কার গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলেন।’
এমবিজেডের বড় গুণ হলো তিনি কখনো এক পক্ষের ওপর নির্ভর করেন না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও সমানতালে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। পশ্চিমা চাপ সত্ত্বেও ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরেননি তিনি। তেলসংকট কাটাতে বাড়তি তেল উৎপাদনে ওয়াশিংটনের আহ্বানেও সাড়া দেয়নি আমিরাত।
‘আমি একজন আরব, একজন মুসলিম। সত্তর ও আশির দশকে আমি তাঁদেরই (মুসলিম ব্রাদারহুডের) একজন ছিলাম। আমি মনে করি, এই লোকগুলোর একটা অ্যাজেন্ডা আছে’মোহাম্মদ বিন জায়েদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট
দেশে শেখ মোহাম্মদকে আধুনিকায়নের কারিগর হিসেবে দেখা হয়। অনেক কূটনীতিকের চোখে তিনি ক্যারিশম্যাটিক নেতা। একসময়কার স্বল্প পরিচিত আবুধাবিকে তিনি জগৎজোড়া পরিচয় এনে দিয়েছেন। জ্বালানি, অবকাঠামো আর প্রযুক্তি খাতে চোখধাঁধানো উন্নয়নে তেলসমৃদ্ধ প্রদেশটি এখন উন্নয়নের পথিকৃৎ।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে আমিরাতের সামরিক বাহিনীকে আরব বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও কার্যকর বাহিনীতে পরিণত করেন এমবিজেড। যুদ্ধবিমান থেকে ড্রোন—আরব বিশ্বে সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহারে এগিয়ে তাঁর বাহিনী। তিনি সচ্ছল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ জাগানোর জন্য সামরিক পরিষেবায় জোর দিয়েছেন।
এমবিজেড ইয়েমেন থেকে লিবিয়া তাঁর সামরিক শক্তি দেখিয়েছেন। লিবিয়ার বিদ্রোহীদের যুদ্ধবিমান ও ড্রোন দিয়ে সহায়তা করেছেন। তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াইরত কুর্দিদেরও তিনি অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ। ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান ও সোমালিয়ায় আমিরাতের স্পেশাল ফোর্স সক্রিয়।
নিজের প্রভাব বাড়াতে সামরিক সহায়তার চেয়েও বড় অস্ত্র ‘পেট্রোডলারকে’ কাজে লাগান তিনি। মিসর, পাকিস্তান ও সুদানের বড় অর্থ সহায়তাকারী এমবিজেড। অপছন্দের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হঠাতে তেল-গ্যাস বিক্রির টাকা ঢালতে কার্পণ্য করেন না তিনি। অর্থনৈতিক সংকটে পড়া তুরস্কও বৈরিতা শিকেয় তুলে আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগের জন্য এমবিজেডের দ্বারস্থ হয়। রাজনৈতিক প্রভাব তৈরিতে বিনিয়োগ তাঁর অন্যতম কৌশল।
এমবিজেডকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়, এমন একটি সূত্রের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা বলেছে, ‘তিনি অন্ধকারে ঢিল ছোড়েন না…তিনি জানতে চান কোন বিষয়টি কাজ করছে না, কেবল সেটিই নয় কোনটি কাজ করছে।’
সুন্নি মুসলিমদের নেতৃত্বের লড়াই এখন গড়িয়েছে দুই মিত্র সৌদি আর আমিরাতের মধ্যে। এই লড়াইয়েও এগিয়ে এমবিজেড। পুরোনো শত্রু এরদোয়ানের পাশাপাশি ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিকের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বিকল্প হিসেবে নিয়েছেন এমবিজেড। তিনি এর মধ্য দিয়ে তেল-গ্যাস তথা প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চান। এমবিজেডের দিকনির্দেশনায় মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছে আমিরাত। মঙ্গলে মিশন পরিচালনা করেছে। দেশটির প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রও চালু হয়েছে।
অসহনীয় তাপমাত্রা থেকে বাঁচতে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঝরিয়েছে আমিরাত। দুবাইয়ে ড্রোনের সাহায্যে মেঘের মধ্যে বৈদ্যুতিক চার্জ সরবরাহের মাধ্যম জলকণা ঘনীভূত করে বৃষ্টি ঝরানো হয়। কৌশলটির নাম ‘ক্লাউড সিডিং’। কম বৃষ্টিপাতের অঞ্চলগুলোয় এটি প্রয়োগ করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশটির নবায়নযোগ্য জ্বালানি তথা সোলার সিস্টেমে বিনিয়োগও যে কাউকে বিস্মিত করবে।
এমবিজেড দুবাইকে করপোরেট বিশ্বের রাজধানীতে পরিণত করেছেন। বিশ্বের বহুজাতিক অনেক কোম্পানির করপোরেট অফিস দুবাইতে। আমিরাতের আবাসন খাতে বিনিয়োগ বিদেশিদের জন্য সবচেয়ে লোভনীয়। অবশ্য দুবাইকে কালো টাকার স্বর্গে পরিণত করারও অভিযোগ রয়েছে শেখ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে। বিশ্বে বিমান পরিবহন ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়া আমিরাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি কতটা, তা অনুমান করা কঠিন। আফ্রিকা, মধ্য এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে বড় কোম্পানিগুলোয় শেয়ার রয়েছে আমিরাতি শেখ ও দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর।
দুবাইয়ে অবস্থিত বুর্জ খলিফা বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে পরিচিত। এটি আমিরাতের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। দেশটির উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রতীক। এ ধরনের অবকাঠামো তৈরি করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এমবিজেড। দুবাইয়ে সমুদ্র ভরাট করে খেজুরগাছের আকৃতির কৃত্রিম দ্বীপ ‘দ্য পাম’ বানিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে এমবিজেড কতটা খেয়ালি, সেটাও জানান দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস পর্যন্ত এমবিজেডের সক্রিয় ভূমিকা দৃশ্যমান। আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করেন। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেছে বাহরাইন ও মরক্কো। একই পথে এগোচ্ছে সুদান ও ওমান। সৌদি আরবকে নিয়েও গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে।
মুসলিম ব্রাদারহুড ও ইরানকে একদমই সহ্য করতে পারেন না এমবিজেড। আরব বসন্ত ঘিরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে খড়্গহস্ত হন তিনি। যদিও আমিরাতের শাসক দাবি করেন, একসময় তাঁদের মতাদর্শের প্রতি দুর্বল ছিলেন তিনি।
মুসলিম ব্রাদারহুডকে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেন এমবিজেড। উইকিলিকসের ফাঁস করা নথি অনুযায়ী, ২০০৭ সালে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমি একজন আরব, একজন মুসলিম। সত্তর ও আশির দশকে আমি তাঁদেরই (মুসলিম ব্রাদারহুডের) একজন ছিলাম। আমি মনে করি, এই লোকগুলোর একটা অ্যাজেন্ডা আছে।’
মিসরে জনগণের ভোটে মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টে মোহাম্মদ মুরসিকে ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাইরে থেকে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন এমবিজেড। দৃশ্যত রাজকীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) ঘনিষ্ঠ সমর্থক তিনি। এমবিজেডের মতে, এমবিএস এমন এক লোক, যাঁর ওপর ভরসা করতে পারে ওয়াশিংটন। আর এমবিএস সৌদি আরবকে প্রগতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে উপসাগরীয় দেশ দুটি ইরানের ওপর ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের জন্য লবি নিয়োগ করে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করায় প্রতিবেশী কাতারকে একঘরে করে ফেলে। যদিও শেষ পর্যন্ত কাতারকে নতি স্বীকার করাতে ব্যর্থ হয়।
ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ আলগা করতে ইয়েমেনে সৌদি জোটের নেতৃত্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়ায় আমিরাত। যদিও স্বার্থের হিসাব-নিকাশে পাকা এমবিজেড যুদ্ধের মাঠে এমবিএসকে অনেকটা একা ছেড়ে এসেছেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে এই যুদ্ধের চাপ আমিরাতের অর্থনীতি বহন করতে পারবে না।
ইয়েমেন থেকে লিবিয়া আর সোমালিয়া থেকে সুদানের রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়েছেন এমবিজেড। তবে লিবিয়ায় তুরস্কের শেষ মুহূর্তের হস্তক্ষেপে খলিফা হাফতারকে ক্ষমতায় বসাতে ব্যর্থ হন তিনি। সোমালিয়ায় তুরস্ক–সমর্থিত সরকারে বিরুদ্ধে লড়াইরত আল-শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করার অভিযোগ আমিরাতের বিরুদ্ধে। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আল-বশির ইসলামপন্থী মিত্রদের ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এলে ২০১৯ সালে আবুধাবি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে তাঁকে সরিয়ে দেয়।
তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদের সম্প্রতি ক্ষমতায় গেড়ে বসার নেপথ্যেও এমবিজেডের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন তিনি। তুরস্ক ও কাতারকে বাদ দিয়ে কাবুল বিমানবন্দরের দেখভালের জন্য আমিরাতের সঙ্গে চুক্তি করেছে তালেবান।
কূটনীতিকেরা বলেন, আরব বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয় বলে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়ে আসছেন এমবিজেড। কারণ, এখানে যেকোনো নির্বাচনে ইসলামপন্থীরাই জয়লাভ করবে। ২০০৭ সালে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আরব বিশ্বের প্রভাবশালী এই নেতা বলেন, ‘যেকোনো মুসলিম দেশে আপনারা একই ফলাফল দেখবেন। মধ্যপ্রাচ্য ক্যালিফোর্নিয়া নয়।’
‘এমবিজেডের বার্তা ছিল, যদি তোমরা আমার ওপর আস্থা রাখো এবং আমাকে পছন্দ করে থাকো, তাহলে তোমরা এই ব্যক্তিকেও (এমবিএস) পছন্দ করবে। কারণ, আমার আর তাঁর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই’বেন রোডেস, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা
দুই পবিত্র মসজিদের ‘খাদেম’ সৌদি আরব সুন্নি মুসলিমদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে সে জায়গা দখলের চেষ্টা করছে ওসমানী খেলাফতের বিলুপ্তির বেদনা বয়ে বেড়ানো তুরস্ক। আঙ্কারাকে ঠেকাতে এই যাত্রায় এক হয় সৌদি-আমিরাত। অবশ্য এই জোটের অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধে আপাতত নতি স্বীকার করেছেন অভ্যন্তরীণ চাপে থাকা এরদোয়ান।
তবে সুন্নি মুসলিমদের নেতৃত্বের লড়াই এখন গড়িয়েছে দুই মিত্র সৌদি আর আমিরাতের মধ্যে। এই লড়াইয়েও এগিয়ে এমবিজেড। পুরোনো শত্রু এরদোয়ানের পাশাপাশি ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিকের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তুরস্কে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে আমিরাতি কোম্পানিগুলো। কয়েক দিন আগে ছয় বছর পর আবার তেহরানে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছে আমিরাত।
এমনকি সৌদি রাজপরিবারে ক্ষমতার লড়াইয়েও নিজেকে জড়িয়েছিলেন এমবিজেড। রিয়াদের ক্ষমতার কেন্দ্রে আনতে ২৯ বছর বয়সী স্বল্প পরিচিতি প্রিন্স এমবিএসের পক্ষে ওয়াশিংটনে সর্বাত্মক লবিং চালিয়েছিলেন তিনি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের আদরের ছেলে এমবিএস। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা বেন রোডেসের কথায়, ‘এমবিজেডের বার্তা ছিল, যদি তোমরা আমার ওপর আস্থা রাখো এবং আমাকে পছন্দ করে থাকো, তাহলে তোমরা এই ব্যক্তিকেও (এমবিএস) পছন্দ করবে। কারণ, আমার আর তাঁর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
ওয়াশিংটনে প্রভাব ধরে রাখতে লবিং ফার্ম ও চিন্তক প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে লাখ লাখ ডলার ঢালে আমিরাত। এ খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। কেবল ২০১৭ সালেই আরব দেশটি এসবের পেছনে দুই কোটি ১০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। এ ছাড়া কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলেই বিশাল অঙ্কের অনুদান নিয়ে হাজির হন এমবিজেড। লক্ষ্য একটাই—যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির মধ্যে প্রভাব ধরে রাখা।
ম্যাকিয়াভেলি চরিত্রের আদর্শ এই শাসক ক্ষমতার যোগসূত্রগুলো ভালো বোঝেন। ১৫ বছর আগে যুবরাজ থাকা অবস্থায়ই আমিরাতের রাজপরিবারে নিজের প্রভাব বিস্তার করেন। একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং বাকি বিশ্বে ক্ষমতার যোগসূত্রও তৈরি করেন এমবিজেড।
নিউইয়র্ক টাইমসে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকান সাংবাদিক ও ‘রেজ অব অর্ডার’ বইয়ের লেখক রবার্ট এফ ওয়ার্থ ‘মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোহাম্মদ বিন জায়েদের ডার্ক ভিশন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমিরাতের এই রহস্যময় নেতা শিগগিরই এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। আসলে তিনি কী চান?’
এমবিজেডের চাওয়া কী, তাঁর তৎপরতাতেই সেটা সহজে অনুমেয়। আরব বিশ্বের ভবিষ্যৎ রাজনীতি যে তিনি ঠিক করবেন, সে পথে অনেকটাই এগিয়েছেন এমবিজেড। সামনের দিনগুলোতে সেটা আরও দৃশ্যমান হবে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস