দিনে শত শত লাশে কাফন পরান সাহের; শঙ্কা, ‘কখনো যদি সন্তানের পালা আসে’

গাজার আল-মাগাজি শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত শিশুসন্তানের লাশ কোলে এক ফিলিস্তিনি বাবা। গাজা উপত্যকা, ৫ নভেম্বর
ছবি: এএফপি

ছোট্ট একটি ঘর। সাদা টাইলস লাগানো। সেখানে প্রতিদিন একমনে কাজ করে যান আবু সাহের আল মাঘারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যায় সাদা কাফনের কাপড় আর মরদেহ নিয়ে। খুব যত্ন করে মৃত মানুষের শরীরে কাফনের কাপড় পরিয়ে দেন তিনি।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার আল-আকসা হাসপাতালে ১৫ বছর ধরে এ কাজ করছেন ৫৩ বছর বয়সী আবু সাহের। তবে ইদানীং তাঁর ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। কারণ, ইসরায়েলের নির্মম হামলার কারণে হাসপাতালটিতে একের পর এক আসছে মরদেহ।

লাশগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন আবু সাহের। তাঁর শুভ্র দাড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড় ছিল চোখের পানি। বললেন, ‘এতটা কঠিন সময় জীবনে কখনো আসেনি। আগে দিনে ৩০ থেকে ৫০টি মরদেহে কাফন পরাতাম। তাঁদের সবার মৃত্যুই স্বাভাবিক ছিল। আর আগে যতবার ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে, তখনো দিনে ৬০টির বেশি মরদেহে কাফন পরাতে হয়নি।’

এখন দিনে প্রায় ১০০ মরদেহে কাফন পরান আবু সাহের। কখনো কখনো এই সংখ্যা ২০০-তে গিয়ে দাঁড়ায়। সংখ্যাটা নির্ভর করে ইসরায়েলের হামলার নৃশংসতার ওপর। আবু সাহের বললেন, ‘হাসপাতালে আসা বেশির ভাগ মরদেহের অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন থাকে। সারা শরীরে থাকে আঘাত আর গভীর ক্ষতের দাগ। এমন কিছু আমি আগে দেখিনি।’

‘শিশুদের মরদেহ দেখলে বুকে ফেটে যায়’

আল-আকসা হাসপাতালে আসা বেশির ভাগ মরদেহই শিশু ও নারীদের। আবু সাহের বললেন, ‘শিশুদের কাফনের কাপড় পরাতে গেলে আমার সবচেয়ে কষ্ট হয়। তাদের ছিন্নভিন্ন শরীর যখন কাফনের ভেতরে একত্র করি, তখন বুকটা যেন ফেটে যায়। ভাবি, তারা (ইসরায়েল) এটা কী করেছে?’

মরদেহ হাসপাতালে আসার পর সেগুলো থেকে ময়লা ও রক্ত মুছে ফেলেন আবু সাহের। কাফনের ওপর লিখে দেন তাঁদের নাম। প্রিয় মানুষটার ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পেতে পারেন—এ কথা ভেবে কাফনের ভেতরে মরদেহের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সাজিয়ে রাখেন তিনি।

৭ অক্টোবর থেকে গত ৩৪ দিনে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় ১০ হাজার ৮০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪ হাজার ৪০০ জনের বেশি শিশু। নিহত নারীর সংখ্যা ২ হাজার ৯০০ জনের বেশি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, গাজা শিশুদের ‘কবরস্থানে’ পরিণত হয়েছে।

আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র মোহাম্মদ আল-হাজের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে হাসপাতালটিতে অন্তত ২ হাজার ৪৭৬ ফিলিস্তিনির মরদেহ আনা হয়েছে। আগে এখানে ২০০টি শয্যা ছিল। তবে গত মাসজুড়ে বোমায় আহত হয়ে ৫ হাজার ৩০০-এর বেশি মানুষ এসেছেন। তাই শয্যা বাড়িয়ে ৪৩১টি করা হয়েছে।  

আবু সাহের বলেন, ‘সব বাবার মতোই আমিও পরিবার নিয়ে ভয় পাই। তবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ আমার খুবই কম। যখন বাড়ি ফিরি, পরিবারের সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় থাকি না।’

আবু সাহেরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বিকেলে। আসরের নামাজের জন্য তখন কাজে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়েছিলেন। বললেন, হাসপাতালে সকাল ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অবিরাম কাজে ব্যস্ত থাকেন তিনি। কিছু মরদেহ আসে খুবই পচাগলা অবস্থায়। বোমার আঘাতে ধ্বংস হওয়া ভবনের নিচে দিনের পর দিন আটকে থাকা এসব মরদেহ থেকে তীব্র দুর্গন্ধও বের হয়।  

আবু সাহের জানালেন, অনেক মরদেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে আসে। কিছু আবার এমনভাবে পোড়া থাকে যে চেনাও যায় না। মরদেহে এমন আঘাত আগে কখনো দেখেননি তিনি। তাঁর মনে হয়, ইসরায়েল হয়তো আগের চেয়ে ভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ব্যবহার করছে।  

ইসরায়েলের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে শিশু সন্তান। কাফনের কাপড়ে মোড়া সন্তানের মরদেহ কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা। গাজার আল–আকসা হাসপাতালের মর্গের সামনে

বিদায় অতি নিষ্ঠুর

প্রতিনিয়ত এই নির্মমতার মধ্যেই  আবু সাহেরকে কাজ করে যেতে হচ্ছে। তাঁর বিশ্বাস, ইসরায়েলের হামলায় যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের অন্তত প্রিয়জনকে শেষবিদায় জানানোর সুযোগটা থাকা দরকার।

আবু সাহের বলেন, ‘হাসপাতালের বাইরে তাকালেই দেখা যায়, সন্তান হারানোর বেদনায় বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়। সন্তানদের জন্য তাঁরা কান্নাকাটি করেন। তাই আমি যতটা সম্ভব সহানুভূতিশীল থাকার চেষ্টা করি। আর শিশুদের মরদেহগুলো যতটা পারি ভালোভাবে বাবা-মায়ের সামনে নিয়ে আসি, যেন তাঁরা শেষবিদায় জানাতে পারেন।’
মরদেহ হাসপাতালে আসার পর সেগুলো থেকে ময়লা ও রক্ত মুছে ফেলেন আবু সাহের। কাফনের ওপর লিখে দেন তাঁদের নাম। প্রিয় মানুষটার ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পেতে পারেন—এ কথা ভেবে কাফনের ভেতরে মরদেহের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সাজিয়ে রাখেন তিনি।

ইসরায়েলের নির্দেশে ফিলিস্তিনিরা যখন থেকে উত্তর গাজা ছাড়া শুরু করেছেন, তখন থেকে আল-আকসা হাসপাতালে আসা মরদেহের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানান আবু সাহের। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের সবাই বেসামরিক লোকজন। তাঁদের মধ্যে শিশু, নারী, পুরুষ—সবাই রয়েছেন। ইসরায়েলের হামলায় তাঁরা নিজ বাড়িতে, বাড়ির বাইরে, এমনকি গাজার দক্ষিণে পালানোর সময়ও মারা যাচ্ছেন।’

গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় সৃষ্ট অগ্নিশিখা

‘তবু তো আমরা মানুষ’

প্রতিদিন শত শত মরদেহে কাফনের কাপড় পরাতে গিয়ে কম মানসিক ধকল সামলাতে হচ্ছে না আবু সাহেরকে। তিনি বলেন, ‘এত সংখ্যক ছিন্নভিন্ন ও পোড়া মরদেহ নিয়ে কাজ করতে মানসিকভাবে খুবই শক্ত হওয়ার দরকার হয়। তার ওপর এসব মরদেহের বেশির ভাগই শিশুর। তাই আমাকে প্রতিদিন কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমার কান্নাকাটি বা ভেঙে পড়ার সুযোগ থাকে না। তারপরও তো আমরা মানুষ।’

প্রতিদিনের কাজের চাপে নিজের পরিবার নিয়ে ভাবার সময় পান না আবু সাহের। তাঁর পরিবার গাজা নগরীর কেন্দ্রে নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে থাকে। সেখানে তাঁর পাঁচ সন্তানও রয়েছে। আবু সাহের বলেন, ‘সব বাবার মতোই, আমিও পরিবার নিয়ে ভয় পাই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ আমার খুবই কম। যখন বাড়ি ফিরি, পরিবারের সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় থাকি না। তাদের বলি, যেন আমাকে একা থাকতে দেওয়া হয়।’

গাজায় দিনের পর দিন বোমা ফেলছে ইসরায়েল। চলছে স্থল অভিযানও। আবু সাহেরের আশঙ্কা, তাঁর বাড়ির কাছেও হয়তো কোনো দিন আঘাত হানবে ইসরায়েলি বোমা। বললেন, ‘আমার প্রায়ই মনে হয়, একদিন হয়তো বোমার নিশানা হবে আমার সন্তানেরা। আমাকে হয়তো তাদের মরদেহে কাফনের কাপড় পরাতে হবে। কারণ, কোনো বাছবিচার ছাড়া সবাইকেই তো নিশানা বানাচ্ছে ইসরায়েল।’