দিনটি ছিল শুক্রবার। সামের (২২) ও ওমর (২৮) খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে অবস্থিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে জুমার নামাজ আদায় করার ইচ্ছা তাঁদের।
দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত ইসাবিয়া এলাকায় সামের ও ওমরদের বাড়ি। সেখান থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ আল-আকসার। শহরের হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ এ মসজিদে আদায় করে থাকেন। তরুণ সামের ও ওমর তাঁদেরই দুজন।
আল-আকসায় জুমার নামাজ আদায় করতে সেদিন সামের ও ওমর যখন দামেস্ক গেটে পৌঁছান, তখন ইসরায়েলি বাহিনী তাঁদের থামতে বলে। ওল্ড সিটিতে ঢুকতে ফিলিস্তিনিরা এই (দামেস্ক গেট) প্রধান প্রবেশপথটি ব্যবহার করে থাকেন।
৫৭ বছরের ইসরায়েলি সামরিক দখলদারির মধ্যে জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিরা এক দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। ৭ অক্টোবরের পর এখানে তাঁদের জীবন ধারণ করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে।
পথ আটকানোর পর সামের ও ওমরকে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যের প্রশ্ন, কোথা থেকে এলে? তাঁদের জবাব, ইসাবিয়া।
ইসাবিয়ায় ফিরে যাও এবং সেখানেই নামাজ পড়ো—পাল্টা জবাব নিরাপত্তা বাহিনীর ওই সদস্যের। জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়ার পথে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর এমন প্রশ্নের মুখে পড়া ও ফেরত যাওয়ার নির্দেশ পাওয়ার কথা জানান আরও কয়েকজন ফিলিস্তিনি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। এর পর থেকে ওল্ড সিটিতে প্রবেশে চূড়ান্ত রকমের কড়াকড়ি আরোপ করে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে গত দুই শুক্রবার এ কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হয়। এতে আরও বেশি মুসল্লি আল-আকসায় নামাজ আদায়ের সুযোগ পান।
নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে বাধা পেয়ে সামের ও ওমর মনে কষ্ট পান। ফিরে যাওয়া শুরু করেন তাঁরা। পথে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশিচৌকির কাছে একটি কেবিন থেকে পানি খেতে কিছু একটা ধরতে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরই ওই বাহিনীর সদস্যরা এসে তাঁদের দুজনকে স্থান ত্যাগ করতে বলেন। কারণ হিসেবে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তাঁরা।
এ ঘটনার পর আল–জাজিরাকে সামের বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ধাক্কাতে শুরু করেন ও পরে আমার বন্ধুকে পেটান। আমরা বলার চেষ্টা করেছি, ‘‘আমাদের মেরো না।”’ নিরাপত্তা বাহিনীর এই সদস্যদের অভিশাপ দেন ফিলিস্তিনি তরুণ ওমর। এর আগে তাঁদের দুজনকে প্রায় ৫০০ মিটার ধাওয়া করে লাঠি দিয়ে পেটান তাঁরা।
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যখন দুই তরুণকে ধাওয়া করেন ও পেটান, তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আল–জাজিরার সংবাদদাতাও। তিনি ওই সদস্যদের একজনকে বলতে শোনেন, ‘ওদের পা ভেঙে দাও, যেন আর ফিরে আসতে না পারে।’
মারধরে ২৮ বছরের তরুণ ওমরের আঘাত ছিল তাঁর বন্ধুর চেয়ে মারাত্মক। তাঁর পায়ে এমন দাগ পড়ে যে মনে হচ্ছিল সেখানে পুড়ে গেছে। ব্যথায় কাতর ওমর হাঁটতে পারছিলেন না।
‘আমরা এখানে (জেরুজালেম) থাকি, তারা সেটা চায় না। তারা দেশ থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিতে চায়। জেরুজালেমে কোনো পুরুষের জন্য জীবন বলতে কিছু নেই। এখানে শুধুই একজন ফিলিস্তিনি পুরুষ হিসেবে টিকে থাকাও তাদের (ইসরায়েল) সহ্য হয় না।’সামের, ফিলিস্তিনি তরুণ
এদিকে আহত সামের বলছিলেন, ‘আমরা এখানে (জেরুজালেম) থাকি, তারা সেটা চায় না। তারা দেশ থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিতে চায়। জেরুজালেমে কোনো পুরুষের জন্য জীবন বলতে কিছু নেই। এখানে শুধুই একজন ফিলিস্তিনি পুরুষ হিসেবে টিকে থাকাটাও তাদের (ইসরায়েল) সহ্য হয় না।’
সামের জানান, এরপরও জেরুজালেমে তাঁদের শক্তভাবে টিকে থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই। তিনি বলেন, ‘দিন শেষে এটি (ইসরায়েলি বাহিনীর কর্মকাণ্ড) তাদের সামরিক দখলদারত্ব। আমরা কখনোই এখান থেকে চলে যাব না, তারা যা-ই করুক।’
এ আলাপ শেষে সামের ও ওমর একটি বাসে উঠে তাঁদের বাড়ির উদ্দেশে ফিরে যান।
৫৭ বছরের ইসরায়েলি সামরিক দখলদারির মধ্যে জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিরা এক দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। ৭ অক্টোবরের পর এখানে তাঁদের জীবন ধারণ করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে।
ওই দিন হামাসের যোদ্ধারা দক্ষিণ ইসরায়েলে আকস্মিক আক্রমণ চালান। তাতে নিহত হন প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি। ২০০–এর বেশি ইসরায়েলিকে বন্দী করে নিয়ে যান যোদ্ধারা। বহুগুণ নৃশংসতায় এর পাল্টা জবাব দিয়ে চলেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের গাজায় ৭ অক্টোবর থেকেই নির্বিচার হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রথমে বিমান থেকে বিরামহীন গোলাবর্ষণ এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা; পরে যুগপৎভাবে স্থল অভিযান।
গত চার মাসে ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতায় এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ২৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির। আহত বা পঙ্গু হয়েছেন আরও অনেকে। ইসরায়েলি অভিযানে ধ্বংসস্তূপ আর নরকে পরিণত হওয়া এই উপত্যকার দূরত্ব জেরুজালেম থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার।
হামাসের হামলার পর আশপাশের এলাকাগুলোর মতো জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতেও মোতায়েন করা হয় হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনা। তাঁরা এসব এলাকায় ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপর আরোপ করেছেন কঠোর বিধিনিষেধ। বাড়তি হিসেবে জেরুজালেমকে করা হয়েছে আরও বিচ্ছিন্ন। দখলকৃত পশ্চিম তীর থেকে শহরটিতে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশের সব অনুমতি বাতিল করা হচ্ছে।
তরুণ ফিলিস্তিনিরা, বিশেষ করে জেরুজালেমে ইসরায়েলি সেনাদের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ওল্ড সিটির বাসিন্দা ও একটি দোকানের মালিক আবু মোহাম্মদ (৩০) বলেন, ৭ অক্টোবরের পর বিশেষত প্রথম কয়েক দিন ও সপ্তাহ ইসরায়েলি সেনারা এখানে (ওল্ড সিটি) বিকেল পাঁচটার পর থেকে কড়াকড়িভাবে কারফিউ কার্যকর করে। আবু মোহাম্মদ আল–জাজিরাকে আরও বলেন, ‘ওই সময়ের পর রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিত না সেনারা। আমরা যদি দাঁড়াতাম, তবে তাঁরা আমাদের পেটাতেন, উসকানিমূলক তল্লাশি ও গালিগালাজ করতেন।’
ইসরায়েলি বাহিনী কীভাবে সহিংসতা শুরু করে এবং জেরুজালেমের এখনকার পরিস্থিতিই-বা কেমন, সে বিষয়ে বর্ণনা দেন আবু মোহাম্মদ। তিনি বলেন, যেকোনো সময় যেকোনো পুরুষ মানুষ ওল্ড সিটিতে ঢুকতে চাইলে সেনারা তাঁর তল্লাশি শুরু করেন। প্রথমে একদল সেনা তাঁকে তল্লাশি করবেন। এ সময় তাঁরা কনুই বা হাঁটু দিয়ে তাঁকে আঘাত ও কিছু বলানোর চেষ্টা করবেন।
তিন সন্তানের বাবা আবু মোহাম্মদ বলেন, ‘এই সময় আপনি যদি কিছু বলেন, দেখবেন তাঁরা সবাই আপনার ওপর চড়ে বসেছেন। তাঁরা আপনার মাথায় ঘুষি মারছেন, সারা দেহে মারছেন। কখনো কখনো আপনাকে হাসপাতালে যেতে হতে পারে।’
আবু মোহাম্মদ বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা বয়স্ক ও অল্পবয়সী—এমন পার্থক্য করে না। আমি সেনাদের বয়স্ক মানুষকেও পেটাতে দেখেছি। তাঁরা কোনোকিছুর তোয়াক্কা করেন না। শহরে এমন কোনো ফিলিস্তিনি পুরুষ পাওয়া যাবে না, যিনি তাঁদের হাতে মার খাননি।’