হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়। লেবানন সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটারের (৩০ মাইল) কম দূরত্বে ইসরায়েলের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান।
ইসরায়েলের দখল করা গোলান মালভূমির একটি ফুটবল মাঠে গত শনিবার এক রকেট হামলায় ১২ শিশু-কিশোর নিহত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ঝুঁকি নেয়নি।
হামলার পরের সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মীদের জানিয়ে দেয়, তাদের ৩০ তলাবিশিষ্ট ভবনের ৫ তলার ওপরে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের আসতে হবে না। তাঁদের বাসায় থেকে কাজ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নেয় মূলত ভয় থেকে। আর ভয় হলো, লেবাননের ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ হামলার নিশানা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মী এস্থার পারপারা বলেন, সবশেষ ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ হয়েছিল। সে সময় হিজবুল্লাহর ছোড়া অস্ত্র হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়েছিল।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এস্থার পারপারা বিবিসিকে বলেন, ‘এটা খুবই বিপজ্জনক একটি সময়। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে টহল দিতে পুলিশ ও রক্ষীদের সহায়তা করছেন অভিভাবকেরা। আমি নিজে ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলছি। আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু হিজবুল্লাহ ইসরায়েল ও ইহুদিদের ধ্বংস করে দিতে চায়।’
আত্মরক্ষার প্রসঙ্গ তুলে এস্থার পারপারা প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা কি নিজেদের রক্ষা না করে হিজবুল্লাহকে তা করতে দিতে পারি?’
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। জবাবে সেদিন থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা যুদ্ধ এখনো চলছে।
গাজায় নির্বিচার হামলার প্রতিবাদ ও হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে ৮ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলও হামলা চালিয়ে জবাব দিচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সীমান্ত হামলা বেড়েই চলছে। বাড়ছে উত্তেজনা।
বিশেষ করে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল ও গোলান মালভূমি এলাকা প্রায়ই হিজবুল্লাহর হামলার নিশানা হচ্ছে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোলান মালভূমিটি সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে নেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক আইনকানুন উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালে ইসরায়েল একতরফাভাবে মালভূমিটি নিজের অংশ করে নেয়।
অন্যদিকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলসহ আশপাশের এলাকায় বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। বিশেষ করে শনিবার গোলান মালভূমির ফুটবল মাঠে রকেট হামলার পর লেবাননে হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল।
অক্টোবরের পর থেকে লেবাননে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় ৪৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন বেসামরিক নাগরিক।
ইসরায়েল বলছে, এই সময়কালে হিজবুল্লাহর হামলায় ২৩ জন বেসামরিক লোকজন ও ১৭ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন।
দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ক্ষেত্রে একটা তুলনামূলক নিয়ন্ত্রিত ভাব লক্ষ করা গেছে। এতে বোঝা যায়, উভয় পক্ষ সরাসরি যুদ্ধ এড়াতে চায়।
কিন্তু এখন যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে এসেছে, তা হলো শনিবারের হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, কতটা তীব্র হবে?
৭ অক্টোবরের পর শনিবারের হামলায় ইসরায়েলে এক দিনে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
হিজবুল্লাহ বলছে, তারা গোলান মালভূমিতে শনিবারের হামলায় জড়িত নয়। তবে ইসরায়েল সরকার বলছে, হিজবুল্লাহর এই দাবি মিথ্যা।
ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলার আশঙ্কায় লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থান ইতিমধ্যে খালি করে দিয়েছে হিজবুল্লাহ।
গোলান মালভূমিতে হামলার সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। নিরাপত্তাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তিনি।
নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, হামলার জন্য হিজবুল্লাহকে চড়া মূল্য দিতে হবে। এই মূল্য এমন হবে, যা আগে কখনো তাদের চুকাতে হয়নি।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে তাঁর মাথা দিয়ে এই হামলার মূল্য চোকানো উচিত।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সতর্ক করে বলেছেন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
তবে ইসরায়েল এটা খুব ভালো করেই জানে যে হিজবুল্লাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ উভয় পক্ষের জন্যই ব্যাপক ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
অঞ্চলটিতে হিজবুল্লাহ সবচেয়ে প্রতাপশালী অরাষ্ট্রীয় শক্তি। হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডারে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র আছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্সি হিজবুল্লাহ।
হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি হামলার শিকার হলে এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে ইরান। ইরান ইতিমধ্যে সতর্ক করে বলেছে, লেবাননের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের নতুন কোনো সামরিক অভিযান অপ্রত্যাশিত পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
ইসরায়েলি সেনারা এখন গাজায় যুদ্ধরত। সেখানে ক্রমেই হামলা জোরদার করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন একটি ফ্রন্টে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করলে তা ইসরায়েলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি অস্ত্রের সংকটও দেখা দিতে পারে।
পাল্টাপাল্টি হামলার জেরে বিগত কয়েক মাসে লেবাননের সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলো থেকে প্রায় ৬০ হাজার ইসরায়েলি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। অনেক ইসরায়েলির দাবি, ইসরায়েল সরকার হিজবুল্লাহকে নিষ্ক্রিয় করে হুমকি দূর করুক।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমছে। তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
সমালোচকেরা বলছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় নানা কঠোর শর্ত জুড়ে দিয়ে নেতানিয়াহু যুদ্ধকে প্রলম্বিত করতে চাইছেন। কেননা, তিনি ভালো করেই জানেন, যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে তাঁকে আগাম নির্বাচনের মুখে পড়তে হতে পরে। সে ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে।
এত কিছুর পরও সরকারের উগ্র ডানপন্থী অংশের চাপে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারেন নেতানিয়াহু। তেমনটা ঘটলে তার পরিণতি বেশ বিপজ্জনক হতে পারে। সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক মহল থেকে উভয় পক্ষের প্রতি সংযত আচরণ করার আহ্বান জোরালো হচ্ছে।