ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগ এবং আগাম নির্বাচনের দাবিতে নেসেটের সামনের সড়কে বিক্ষোভ। ৩১ মার্চ, জেরুজালেম
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগ এবং আগাম নির্বাচনের দাবিতে নেসেটের সামনের সড়কে বিক্ষোভ। ৩১ মার্চ, জেরুজালেম

নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবন শেষ করার জন্য চাপ বাড়ছে

ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিভক্তি আবারও প্রকাশ্যে এসেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলবাসী প্রচণ্ড ধাক্কা খান এবং দেশটিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে, তাতে ওই বিভক্তি কিছু সময়ের জন্য আড়ালে ছিল। তবে তারপর ছয় মাস না যেতেই আবারও ইসরায়েলের রাজপথে নেমেছেন হাজারো বিক্ষোভকারী।

হামাসের হামলার জবাবে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তা ওই বিক্ষোভকারীদের একটি সংকল্পকে আরও জোরদার করে তুলেছে। তা হলো দেশটির দীর্ঘ দিনের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গদি থেকে হটানো।

তবে রাজপথে পুলিশের বড় বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের। যেমনটা হয়েছে জেরুজালেমে। শহরটির উত্তর–দক্ষিণ বরাবর প্রধান মহাসড়ক বেগিন বুলেভার্ড অবরোধ করেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান থেকে দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছিটায় ইসরায়েলি পুলিশ।

নেতানিয়াহুর পদত্যাগ ও আগাম নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভকারীদের যেসব স্লোগান আগে থেকেই সুপরিচিত ছিল, তাতে নতুন যুক্ত হয়েছে গাজায় এখনো জিম্মি থাকা প্রায় ১৩০ জনকে মুক্ত করার দাবি। জিম্মি এসব ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

৭ অক্টোবর এই জিম্মিদের ইসরায়েল থেকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে গিয়েছিলেন হামাস সদস্যরা। বিক্ষোভকারীদের মতো এই জিম্মিদের পরিবারের সদস্য ও কাছের মানুষদের মনে একটা বড় ভয় কাজ করছে—তা হলো কোনো চুক্তি ছাড়া যুদ্ধ যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে জিম্মিদের অনেকেই হয়তো বন্দী অবস্থাতেই মারা যাবেন।

গত রোববার সন্ধ্যায় ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের চারপাশে জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। তাঁদের একজন কাতিয়া আমোরজা। এই নারীর সন্তান গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযানে অংশ নিয়েছেন। একটি হ্যান্ডমাইকে স্লোগান দিচ্ছিলেন তিনি।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু  

কিছু সময়ের জন্য মাইকটি নামিয়ে আমোরজা বললেন, ‘সকাল আটটা থেকে আমি এখানে আছি। আর এখন আমি নেতানিয়াহুকে বলছি, তাঁকে (উড়োজাহাজের) একটি প্রথম শ্রেণির একমুখী (ওয়ান–ওয়ে) টিকিট কিনে দিতে পারলে খুশি হব। সেটি দিয়ে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, আর কখনো ফিরবেন না।’

আমোরজার চাওয়া শুধু এটুকুই নয়। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি আরও বলছি, তিনি যেন সঙ্গে করে ওই লোকগুলোকেও নিয়ে যান, যাঁদের তিনি এক এক করে সরকারে নিয়েছেন। এই মানুষগুলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট, আমাদের সমাজে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট।’

আমোরজা যখন মাইকে স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ইহুদিদের ধর্মীয় একজন নেতা—নাম ইয়েহুদাহ গ্লিক। তাঁর মতামতটা অবশ্য ভিন্ন। গ্লিকের ভাষ্য, বিক্ষোভকারীরা এটা ভুলে গেছেন যে তাঁদের আসল শত্রু হামাস, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নন।

ইয়েহুদাহ গ্লিক বলেন, ‘আমি মনে করি, তিনি খুবই জনপ্রিয়। আর সেটিই এই মানুষগুলোকে (বিক্ষোভকারী) উত্তেজিত করে তুলছে। আমি মনে করি, তাঁরা এই সত্যটা মেনে নিতে চাচ্ছেন না যে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন, তারপরও তিনি ক্ষমতায় রয়েছেন।’

নেতানিয়াহু একসময় বলতেন, একমাত্র তিনিই ইসরায়েলকে নিরাপদ রাখতে পারেন। অনেক ইসরায়েলিও তাঁকে বিশ্বাস করতেন। নেতানিয়াহুর ভাষ্য ছিল, তিনিই ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। ইসরায়েলের অধিকৃত ভূখণ্ডে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, সেখানে ইহুদিদের বসতি স্থাপন করে দেবেন। আর এ জন্য ইসরায়েলকে কোনো কিছু ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।

তবে সবকিছু বদলে দেয় ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলে হামাসের হামলা। নিরাপত্তার এই ব্যর্থতার জন্য অনেক ইসরায়েলিই নেতানিয়াহুকে দায়ী মনে করেন। ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকে বিবৃতি দিয়ে স্বীকার করেছেন, তাঁদের ভুলে হামাসের হামলা হয়েছে। তবে নেতানিয়াহু ব্যতিক্রম। এই হামলার কোনো দায় কখনোই তিনি নেননি। এতেই চটেছেন রোববার সন্ধ্যায় রাজপথে নামা বিক্ষোভকারীরা।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে জেরুজালেমে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের বাইরে বিক্ষোভের এই ছবি ড্রোন দিয়ে নেওয়া। ৩১ মার্চ, জেরুজালেম

একসময় ইসরায়েলের রাজনীতিতে এতটা প্রভাবশালী চরিত্র ছিলেন না নেতানিয়াহু। সে সময়টার কথা সেসব ইসরায়েলিই মনে করতে পারবেন, যাঁদের বয়স মোটামুটি ৪০ বছর। অসলো শান্তি চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৯৬ সালে। ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসলো চুক্তি করা হয়েছিল। তবে নেতানিয়াহু বরাবরই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দেওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের যে কৌশল, সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি।

নেতানিয়াহুর সমালোচকেরা বলে থাকেন, গাজায় যুদ্ধ শেষে উপত্যকাটির শাসন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া পরিকল্পনা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন নেতানিয়াহু। কারণ, এই প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে তিনি ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থীদের কাছ থেকে অব্যাহতভাবে সমর্থন পেতে চান।  

রোববার নেসেটের বাইরে যাঁরা বিক্ষোভ করছিলেন, তাঁদের একজন ডেভিড আগমন। তিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আগমন বলেন, ‘১৯৪৮ সালের পর থেকে এটা সবচেয়ে বড় সংকট। আমি আপনাকে ভিন্ন কিছু শোনাব। ১৯৯৬ সালে আমি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা ছিলাম। তবে তিন মাস পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি ইসরায়েলের জন্য একটি বিপদ।’

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগ এবং গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ। ৩০ মার্চ, তেল আবিব

ডেভিড আগমন বলেন, ‘তিনি (নেতানিয়াহু) জানেন না কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তিনি একজন ভিতু মানুষ। তিনি একটি জিনিসই জানেন, তা হলো কথা বলা। আরেকটি বিষয় বলতে চাই, আমি দেখেছিলাম তিনি স্ত্রীর ওপর নির্ভর করেন। আমি তাঁকে মিথ্যা বলতেও দেখেছি। তিন মাস পর আমি তাঁকে বলেছিলাম, বিবি, আপনার সহকারী দরকার নেই। দরকার আপনার পদে অন্য লোক। তারপর আমি চলে আসি।’

নেসেটের বাইরে রাজপথে যখন বিক্ষোভ চলছিল, তখনো নেতানিয়াহু আগাম নির্বাচনের বিষয়টি নাকচ করে দেন। আর বরাবরের মতোই হামাস নির্মূলে দক্ষিণ গাজার রাফায় নতুন করে হামলার পরিকল্পনার কথা বলেন। হামাসকে নির্মূলের বিষয়ে ইসরায়েলিদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই, বরং বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। তবে যে কৌশলে গাজার যুদ্ধটা ইসরায়েল পরিচালনা করছে, আর সব জিম্মিকে মুক্ত করতে দেশটির সরকার যে ব্যর্থতা দেখিয়েছে, তাতে নেতানিয়াহু বড় চাপে পড়েছেন। এই চাপ তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে।