ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার ৬০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি
ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার ৬০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি

গাজাবাসীর অবর্ণনীয় কষ্টের শেষ কোথায়

ইসরায়েলি নৃশংসতার ছয় মাস পার করলেন ফিলিস্তিনের গাজাবাসী। এই সময়টাতে দুর্দশার চরম রূপটা দেখেছেন উপত্যকাটির বাসিন্দারা। শিগগিরই এ দুর্দশা কাটার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, চলমান সংঘাত থামাতে ইসরায়েলের কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও রক্তক্ষয়ী এ সংঘাত ঘিরে নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে দেশটি।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা কর্তৃপক্ষ শনিবার জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় গত ছয় মাসে উপত্যকাটিতে ৩৩ হাজার ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৮১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশই নিরপরাধ শিশু। রয়েছেন বহু নারীও।

হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও গত ছয় মাসে গাজায় অবর্ণনীয় তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরায়েল। উপত্যকাটির অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট ৩৯২টি স্থাপনা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের ২৪টির বেশি সেবা দিতে পারছে না। ১২৩টি অ্যাম্বুলেন্স আর ব্যবহারযোগ্য নেই। ইসরায়েলে হামলা থেকে রেহাই পায়নি সেখানকার ১৮৪টি মসজিদও।

হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি গাজা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। প্রয়োজনীয় ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না। এতে চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন গাজার বাসিন্দারা। সেখানে নেই খাবার, নেই পানি, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। তারপর আবার হামলার মুখে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার তিন–চতুর্থাংশ বাসিন্দা। সতর্কতা জারি করে জাতিসংঘ বলেছে, গাজা দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে ঘরে–বাইরে চাপের মুখে পড়ছে ইসরায়েল সরকার। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রও এখন গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার সমালোচনায় মুখর হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চলছে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ। ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের দেশে ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভের জোয়ার উঠেছে ইসরায়েলেও। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করছেন অনেক ইসরায়েলি।
লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ ইসরায়েল

৭ অক্টোবর হামলা শুরুর সময় গাজায় দুটি লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিল ইসরায়েল। প্রথমটি—উপত্যকাটির শাসকগোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল। দ্বিতীয়টি—হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের দেশে ফিরিয়ে আনা। বিশ্লেষকদের অনেকের ভাষ্য, গত ছয় মাসে এই দুই লক্ষ্যের কোনোটিই অর্জন করতে পারেননি নেতানিয়াহু।

যদিও চলমান সংঘাতে গাজায় নিজেদের সফলতার কিছু ফিরিস্তি দিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। তাদের দাবি, শীর্ষস্থানীয় বেশির ভাগ নেতাসহ হামাসের কয়েক হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে তারা। গত নভেম্বরে যুদ্ধবিরতির সময় শতাধিক জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরপরও হামাসের হাতে বর্তমানে জিম্মি প্রায় ১৩০ জন। আশঙ্কা—তাঁদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক খালেদ এলগিন্দি বলেন, ‘গাজায় চলমান সংঘাতের স্থায়িত্ব, তীব্রতা, ব্যাপকতা ও প্রাণহানি নিয়ে সবাই যে আশঙ্কা করছিলেন, আমার ধারণা, তা বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে। গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে ইসরায়েলের কোনো কার্যকর পরিকল্পনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউই জানেন না কবে, কীভাবে এ যুদ্ধ শেষ হবে।’

‘হামাস নির্মূল সম্ভব নয়’

২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন শুরু করে হামাস। তখন থেকেই উপত্যকাটির নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক নানা বিষয়ের দেখভাল করে আসছে সংগঠনটি। হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল হামলা শুরু করেছিল, তার পক্ষে দেশটির প্রায় সব মানুষ। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে জেরুজালেমভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও লেখক নাথান থরাল বলেন, ‘ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতে পারবে না। কারণ, পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। বিগত মাসগুলোয় হামাসের জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।’

৭ অক্টোবর গাজাজুড়ে বোমাবর্ষণ শুরুর পর ওই মাসের শেষের দিকে উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। পরে দক্ষিণেও স্থল অভিযান চালানো হয়। ইসরায়েলের দাবি, এসব অঞ্চলে হামাসকে পরাজিত করেছে তারা। এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য সর্ব দক্ষিণে মিসর সীমান্তের রাফা এলাকা। হামলার মুখে গাজার ২৪ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে।

নাথান থরাল বলেন, ‘উত্তরে হামাসকে পরাজিত করা হয়েছে—ইসরায়েলের এমন দাবির পর থেকে আপনি দেখতে পাবেন, প্রতি সপ্তাহেই সেখানে ইসরায়েলি সেনারা মারা যাচ্ছেন। ইসরায়েল রাফায় হামলা চালাক বা না চালাক, তাই এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধের পরও হামাস থেকে যাবে। এর অর্থ সংঘাত থেকে বের হওয়ার কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই ইসরায়েলি নেতাদের সামনে।’  

ভবিষ্যতে কী হবে

গত ফেব্রুয়ারিতে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, যুদ্ধের পর তিনি গাজাকে সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে চান। মিসরের সঙ্গে উপত্যকাটির সীমান্তও বন্ধ করবেন। ঢেলে সাজাবেন সেখানকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। একই সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মহলের যে চাপ রয়েছে, তা–ও অগ্রাহ্য করেন তিনি। যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের গাজা শাসনের বিষয়টিও উড়িয়ে দিয়েছে তাঁর সরকার।

গাজায় শিগগিরই যুদ্ধবিরতির কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। গত নভেম্বরের পর নতুন যুদ্ধবিরতির সব আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলেও তা নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। জাতিসংঘের সমালোচনা করে নেতানিয়াহু সরকার বলেছে, কেউ পাশে না থাকলেও গাজায় হামলা চালিয়ে যাবে তারা।  

এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কী হতে পারে, তা সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন গবেষক খালেদ এলগিন্দি। তিনি বলেন, যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তা হলো গাজায় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী থেকে যাবে। এতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে। কেউ যদি মনে করে গাজায় এমন অবস্থা চলছে, তা ইসরায়েলিদের জন্য নিরাপত্তা বয়ে আনবে, তাহলে তিনি বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।