মার্কিন সমর্থনই ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলায় মদদ জোগাচ্ছে

শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি অভিযানের পর বিধ্বস্ত সড়ক ধরে হেঁটে আসছেন এক প্রবীণ দম্পতি। দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন, ৪ জুলাই
ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তারা দখলকৃত জেনিন শহরের শরণার্থী শিবিরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। একইসঙ্গে চালিয়েছে বড় ধরনের সামরিক অভিযান। এ সময় কমপক্ষে ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার শুরু হওয়া এই অভিযানে বিপুলসংখ্যক ইসরায়েলি বাহিনী শরণার্থী শিবিরে অনুপ্রবেশ করে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, বারবার ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংস হামলা চালানোর পেছনে ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকারকে সক্ষম করে তুলছে এবং উৎসাহ জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অটুট সমর্থন ও সহায়তা।

ইসরায়েলের হাজারো সেনা যখন গতকাল জেনিনের জনবহুল শরণার্থী শিবিরে অভিযান চালায়, তখন একইসঙ্গে চলে আকাশপথে একের পর এক হামলা, তখন হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এ নিয়ে সাফাই গাওয়া হয়েছে। জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার রয়েছে।

আমার ধারণা, অতীতে যেমন ঘটতে দেখেছি, ভবিষ্যতেও একই ঘটনা আমরা বারবার দেখব। মার্কিন প্রশাসন পেছন থেকে ইসরায়েলকে সমর্থন জোগাবে। আর ইসরায়েল সরকার যা ইচ্ছা, তা–ই করবে
ড্যানিয়েল লেভি, থিংক ট্যাংক ইউএস/মিডল ইস্ট প্রজেক্টের প্রেসিডেন্ট।
ইসরায়েলি হামলার পর ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন, ৩ জুলাই

এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল বলেছে, ‘হামাস, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতার বিপরীতে আমরা ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও নিজেদের জনগণকে রক্ষার অধিকারকে সমর্থন করি।’

এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূলকথা—বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষা করা। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক রাজনীতিতেও মার্কিন প্রশাসনের অগ্রাধিকার এটা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরায়েলের নৃশংস সামরিক অভিযানের বিষয়ে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া বলে দিচ্ছে, ইসরায়েলের লাগাম টানতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইচ্ছা নেই। সেই সঙ্গে জেনিনে ইসরায়েলি অভিযান জোরদার হওয়ায় উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গতকাল থিংক ট্যাংক ইউএস/মিডল ইস্ট প্রজেক্টের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল লেভি বলেন, ‘আমার ধারণা, অতীতে যেমন ঘটতে দেখেছি, ভবিষ্যতেও একই ঘটনা আমরা বারবার দেখব। মার্কিন প্রশাসন পেছন থেকে ইসরায়েলকে সমর্থন জোগাবে। আর ইসরায়েল সরকার যা ইচ্ছা, তা–ই করবে।’

ড্যানিয়েল লেভির মতে, ফিলিস্তিনে সংকটময় পরিস্থিতি আরও বেড়ে যাক, এটা বাইডেন প্রশাসন চায় না। তবে এসব নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে নিজেদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কোনো ঝুঁকি নিতে নারাজ ওয়াশিংটন। এ কারণেই ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েল যখন জেনিনের শরণার্থী শিবিরে ২০০২ সালের পর সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি নিষ্ঠুর অবহেলা দেখাচ্ছে, তখন বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে দেওয়া সহায়তা অব্যাহত রেখে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে
আহমাদ আবুজনাইদ, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ইউএস ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টিনিয়ান রাইটসের পরিচালক।

মার্কিন সহায়তা অব্যাহত

জেনিনে শরণার্থী শিবিরে বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করলেও ইসরায়েলের ভাষ্য, তাদের উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের নিবৃত করা। গত মাসে দখলকৃত পশ্চিম তীরের উত্তরাংশে দুজন ফিলিস্তিনি বন্দুকধারী গুলি চালিয়ে চারজন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীকে হত্যা করেন। এর জবাবে জেনিনের শরণার্থী শিবিরে অভিযান চালালো ইসরায়েল।

এ ঘটনায় হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হলেও তাতে ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের কথা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি উত্তেজনা কমানোর কথাও বলা হয়নি। পরে গতকাল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘বেসামরিক মানুষের জীবনহানি ঠেকাতে সম্ভাব্য সব সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।’

ফিলিস্তিনি থিংক ট্যাংক আল–শাবাকার মার্কিন নীতিবিষয়ক ফেলো তারিক কেনি–শাওয়া বলেন, ‘সংঘাতের বিষয়ে মার্কিন নীতি ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে।’

ইসরায়েল সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কেননা, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেকোনো পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা নেই নেতানিয়াহু সরকারের
নিহাদ আওয়াদ, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনসের পরিচালক।

তারিক আরও বলেন, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিষয়ে জো বাইডেন প্রশাসন এক জটিল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ‘দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের’ প্রতীকী কথাবার্তা বলা থেকে বিরত রয়েছে ওয়াশিংটন। এমনকি এখনকার সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সবাইকে সংযত থাকার কথাও বলছে না।

অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ইউএস ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টিনিয়ান রাইটসের পরিচালক আহমাদ আবুজনাইদ ওয়াশিংটনের এমন নীতির নিন্দা জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এত কিছুর পরও ইসরায়েলকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত রাখা আশ্চর্যজনক কোনো ঘটনা নয়। গুরুতর নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইসরায়েল প্রতিবছর কমপক্ষে ৩৮০ কোটি ডলার সহায়তা পায়।

আহমাদ আবুজনাইদ বলেন, ‘ইসরায়েল যখন জেনিনের শরণার্থী শিবিরে ২০০২ সালের পর সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি নিষ্ঠুর অবহেলা দেখাচ্ছে, তখন বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে দেওয়া সহায়তা অব্যাহত রেখে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।’

এই বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের আচরণ বর্ণবাদী ও আগ্রাসী। দেশটি ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে। ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করছে। এ পরিস্থিতিতে এমন বড় ধরনের ঔপনিবেশিক সহিংস আচরণকে ভিন্ন কিছু হিসেবে চিহ্নিত করা অযৌক্তিক হবে।

সমর্থন জোগাচ্ছে ওয়াশিংটন

কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন অধিকৃত পশ্চিম তীরে সামরিক তল্লাশি–অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। ২০০২ সালের শেষের দিকে ইসরায়েলে ক্ষমতায় আসেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তাঁর ডানপন্থী শাসনামলে ফিলিস্তিনিদের প্রতি এমন নিত্যদিনের ভোগান্তি অনেক বেড়ে গেছে।

একইসঙ্গে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে নেতানিয়াহু সরকার। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বসতি স্থাপনকারীদের সুরক্ষা দেয়। তাই, তাঁরাও স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা–নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও মার্কিন প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। এমনকি বসতি সম্প্রসারণে নেতানিয়াহু সরকারের নীতির সমালোচনা করেছে। কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করেনি বরং সম্পর্ক জোরদার করেছে।  

এদিকে আরব রাষ্ট্র, বিশেষত সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মী ও সংস্থাগুলো এর বিরোধিতা করেছে।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘আমরা ইসরায়েলে আমাদের বন্ধু ও মিত্রদের বলেছি, যদি তাঁদের বাড়ির উঠানে আগুন জ্বলতে থাকে, সেই পরিস্থিতি অনেক কঠিন হবে। তাই, সম্ভব হলে বিদ্যমান চুক্তিগুলোর মেয়াদ আরও বর্ধিত করতে হবে। সেই আলোচনায় সৌদি আরবকেও যুক্ত করতে হবে।’

জেনিনের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা–অভিযান–হত্যার পরও নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের অকুণ্ঠ সমর্থন অনেক বিশ্লেষককে অবাক করেছে। তাঁদের অনেকেই বলছেন, এই পরিস্থিতিতে আরও জরুরি পদক্ষেপ নিতে বাইডেন প্রশাসনকে চাপ দিতে হবে।

পরিণতির আশঙ্কা নেই

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) পশ্চিম তীরের জেনিনে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান ‘যুদ্ধাপরাধ’ বন্ধে দ্রুত ‘দৃঢ় পদক্ষেপ’ নিতে বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটির পরিচালক নিহাদ আওয়াদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসরায়েল সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কেননা, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেকোনো পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা নেই নেতানিয়াহু সরকারের।’ নিহাদের মতে, ‘এ অবস্থার পরিবর্তন করা উচিত।’

তারিক কেনি–শাওয়ার মতে, জেনিনের ঘটনা ‘বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য’। কেননা এখানকার শরণার্থী শিবিরে বড় পরিসরে অভিযান ও হামলা চালানো হয়েছে। স্থানীয় অভিবাসী ও চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন, অভিযানের সময় শিবিরের ভেতরের সড়ক খুঁড়ে ফেলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বাধা হয়েছে।

ইসরায়েলের এসব কৌশল ভীষণ বর্ণবাদী। এসব কৌশল ব্যবহার করে গাজাকে ধ্বংস করা হয়েছে, এখন ঠিক সেসব কৌশল পশ্চিম তীরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে শুরু করেছে ইসরায়েল, এমনটাই মনে করছেন তারিক কেনি–শাওয়ার। তিনি বলেন, বিমান হামলা ও সড়ক খুঁড়ে ফেলার বুলডোজার জেনিন ও আশপাশের এলাকায় ফিলিস্তিনিদের স্বপ্নভঙ্গে ‘সম্মিলিত শাস্তি’ হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

  • আলি হার্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক একজন বিশ্লেষক। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, মানবাধিকার, আরব–আমেরিকান বিভিন্ন ইস্যুতে লেখালেখি করেন তিনি।