সদ্যোজাত অপরিণত সন্তান নিয়ে আতঙ্কে গাজার মায়েরা

গাজার আল শিফা হাসপাতালে অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া এক শিশুকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে
ছবি: রয়টার্স

ছোট্ট তালিয়ার জন্ম গত ৬ অক্টোবর। গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল হাসপাতালে তার জন্ম নেয়। জন্মের পরপর তার ফুসফুস নিজের মতো কাজ করতে পারছিল না। এ কারণে ভেন্টিলেটরের সাহায্যে তার শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এমন পরিস্থিতি পৃথিবী বোঝার আগেই হয়তো বোমার শব্দ মানিয়ে নিয়েছে ছোট্ট তালিয়ার কান। কারণ, তার জন্মের এক দিন পরেই ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। এর পর থেকেই গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। অন্যান্য মানুষের মতোই তালিয়ার সঙ্গে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তালিয়াকে নিয়ে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন ২৫ বছর বয়সী মা সমর আওয়াদ। তিনি বলেছেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন, তালিয়ার ফুসফুসে পানি জমেছে। তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। চারদিকে এখন থমথমে পরিবেশ, যুদ্ধ পরিস্থিতি। আর এ পরিস্থিতির মধ্যেও তাদের হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। তালিয়া এখনো বাড়ি যেতে পারেনি।

ইসরায়েলের অবরোধের মধ্যে গাজায় জ্বালানি সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। গাজার হাসপাতালগুলো আগেই সতর্ক করেছিল প্রশাসনকে। জ্বালানি না থাকলে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরের ওপর নির্ভরশীল নবজাতক শিশু কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যেতে পারে। জ্বালানিঘাটতির কারণে গাজার একমাত্র ক্যানসার হাসপাতালটিও বন্ধ হয়ে গেছে।

নাসের মেডিকেল হাসপাতালের শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ আসাদ আল-নাওয়াজা আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘গাজায় শিশু, অসুস্থ এবং আহত ব্যক্তিদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে হাসপাতালের জেনারেটর চালু রাখতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য বারবার আবেদন করছি। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। হাসপাতালের নবজাতক জরুরি ইউনিটে ১০টির মতো নবজাতক শিশু রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন নির্ধারিত তারিখের চার সপ্তাহ আগে জন্মেছে। তাদের কাউকেই প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।’

৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় নিয়মিত বোমা হামলা চলছে। গাজায় এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে তিন হাজারের বেশি শিশু রয়েছে। ইসরায়েলি সরকার উত্তরাঞ্চল খালি করার আদেশ জারি করার পর থেকে খান ইউনিস ও রাফাহর দক্ষিণের জেলাগুলোতে হাজারো মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

গাজায় বিমান হামলা অব্যাহত আছে। এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তালিয়ার মা সমর আওয়াদ। তিনি হাসপাতালে আর বাড়িতে তাঁর স্বামী ও তিন বছর বয়সী ছেলে আছে। এ কারণে তিনি আতঙ্কিত, বোমা হামলার ঘটনায় তাঁর স্বামী ও সন্তানেরও যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। এ ছাড়া তালিয়াকে বাঁচিয়ে রাখার মেশিনটিও যেকোনো সময় থেমে যেতে পারে বলেও ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

সমর আওয়াদ বলেন, ‘হাসপাতালের জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে—এই ভয়ে আছি। আমি চাই, যুদ্ধ বন্ধ হোক। আমি চাই, আমার মেয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়ে তার ভাই ও বাবার সঙ্গে থাকুক। তারা খুব মিস করছে তালিয়াকে।’

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্যানুসারে, অবরুদ্ধ গাজা অঞ্চলে ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী আছেন। আর প্রতিদিন ১৬০ জনের বেশি নারী প্রসব করছেন।

ফিলিস্তিনে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ডমিনিক অ্যালেন বলেছেন, প্রায় ১৫ শতাংশ মায়ের সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে জটিলতা দেখা দেয়। এই নারীদের জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়া দরকার। কিন্তু ইসরায়েলের হামলা-অবরোধের কারণে গাজার স্বাস্থ্যসেবা-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

গাজায় ইউএনএফপিএ গর্ভবতী নারীদের জন্য ‘জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা’র ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়ে ডমিনিক অ্যালেন বলেছেন, ‘গাজায় আমরা যে মানবিক বিপর্যয় দেখছি, তা কমানোর জন্য মানবিক সাহায্য ও সরবরাহের অনুমতি দেওয়া উচিত।’

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ বলছে, গাজার ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ১২টি এবং ৭২টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকের মধ্যে ৪৬টি বন্ধ হয়ে গেছে।

ইসরায়েল সম্প্রতি মিসরের সঙ্গে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে ত্রাণবাহী কয়েকটি ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে জ্বালানি প্রবেশ নিষিদ্ধ আছে।

গাজা শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফাও চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজের এ অবস্থাকে ‘বিপর্যয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রিম্যাচিউর অ্যান্ড নিওনেটাল কেয়ার বিভাগের প্রধান নাসের ফুয়াদ বুলবুল বলেছেন, ‘আমাদের জীবনের মৌলিক চাহিদার অভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পানির ঘাটতিও চরম মাত্রায় রয়েছে।’

জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ হাসপাতাল প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পারছে না। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সামগ্রী, ভেন্টিলেটর ও প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধের তীব্র ঘাটতি গাজার মানুষের জীবনকে অবর্ণনীয় কষ্টের মুখে ফেলে দিচ্ছে।

জাতিসংঘ বলেছে, খাওয়ার পানি, ধোয়া, রান্না, শৌচাগারে ব্যবহারসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ন্যূনতম দৈনিক ৫০ লিটার পানি দরকার। কিন্তু বর্তমানে দিনে একজন মানুষমাত্র তিন লিটার পানি পাচ্ছে।

নাসের ফুয়াদ বুলবুল বলেন, সম্পদ কমে যাওয়ায় চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অকালপ্রসবের হারও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিকে ‘ভয় ও সন্ত্রাস’ হিসেবে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আমরা কী করব, তা জানি না। কারণ, আমরা চিকিৎসা সরবরাহ, ভেন্টিলেটর ও জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় ওষুধের তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়েছি।’

আল-শিফা হাসপাতালের ধাত্রী ইয়াসমিন আহমেদ বলেন, হাসপাতালের অধিকাংশ শিশুই তাদের পরিবারে বেঁচে থাকা একমাত্র সদস্য। তাদের যত্ন নেওয়ার কেউ নেই। তাদের জীবনও এখন হুমকির মুখে। কারণ, যেকোনো সময় বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে। এতে তাদের জীবন হারাতে হতে পারে।

এদিকে খান ইউনিসের ২৭ বছর বয়সী লিনা রাবি সন্তান ধারণের জন্য অনেক বছর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে অবশেষে তাঁর ছেলে মারওয়ানের জন্ম হয়। তিনি বলেন, ‘গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের প্রথম সপ্তাহে সন্তানের জন্ম হয়। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ছোট্ট মারওয়ানের জীবন হুমকির মধ্যে আছে।’ মারওয়ানকে নাসের হাসপাতালের একটি ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে।

রাবি বলেন, ‘প্রতি সেকেন্ডে যুদ্ধ চলছে। আমার সন্তানসহ সব শিশুর কথা ভেবে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। আশা করি, যুদ্ধ শেষ হবে। আমার ছেলে সুস্থ হয়ে উঠবে। তারপর প্রাণভরে সন্তানকে জড়িয়ে ধরব আমি।’