ঘন সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল। আছে পাখির অভয়ারণ্যও। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধে এ সবুজ প্রকৃতি তার আসল রূপ হারাচ্ছে। দুই পক্ষের বিস্ফোরিত গোলার টুকরায় মারা পড়ছে পাখপাখালি, বুনো শূকরের দল। পুড়ে ভস্ম হচ্ছে গাছপালা।
উত্তর ইসরায়েলের সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার একটি হুলা ভ্যালি। বিপুলসংখ্যক পাখির আবাস সেখানে। এদের মধ্যে আছে ধূসর সারসের ঝাঁক। পাখির কলকাকলিতে সব সময় মুখর থাকত এ এলাকা। কিন্তু এখন দৃশ্য বদলেছে।
এ এলাকার অদূরে ওপারে লেবানন সীমান্তে ‘হিজবুল্লাহর অবস্থান’ লক্ষ্য করে অনেক দিন ধরেই কামানের গোলা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে ইসরায়েলি বাহিনী। আর এপারে আকাশে চক্কর দিচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক হেলিকপ্টার। গোলার বিস্ফোরণে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়া আর হেলিকপ্টারের কান ঝালাপালা শব্দে পাখিগুলোর ওই অভয়ারণ্য রীতিমতো হুমকির মুখে।
এক বছরের বেশি সময় আগে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। দুই পক্ষের এ লড়াইয়ের প্রভাব প্রকৃতিতেও, বিশেষ করে লেবানন সীমান্তের কাছে ইসরায়েলের ‘আগামন হুলা ভ্যালি নেচার রিজার্ভ’-এ এখন স্পষ্ট।
ইনবার রুবিন এ অভয়ারণ্যের একজন মাঠ পরিচালক। অন্যান্য প্রাণিকুলের পাশাপাশি পাখিগুলোর ওপর ওই যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে তিনি চিন্তিত।
এক বছরের বেশি সময় আগে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। দুই পক্ষের এ লড়াইয়ের প্রভাব প্রকৃতিতেও, বিশেষ করে লেবানন সীমান্তের কাছে ইসরায়েলের ‘আগামন হুলা ভ্যালি নেচার রিজার্ভ’-এ এখন স্পষ্ট।
রুবিন বলছিলেন তাঁর সেই চিন্তার কথা, ‘যুদ্ধের হাঙ্গামা, বোমার বিস্ফোরণ, রকেটের আঘাত—সব শব্দই পাখিগুলো শুনতে পায়। এদের জন্য এগুলো ভীষণ চাপের।’
যুদ্ধের কারণে পর্যটকেরাও এ অভয়ারণ্য দেখতে আসেন না। লেবানন সীমান্ত থেকে আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল) দূরে এটির অবস্থান।
রুবিন বলেন, ‘(অভয়ারণ্যে পর্যটকদের আগমন বন্ধ হওয়ার পর) লোকজন আমাকে বলতেন, “বাহ্, মানুষের আনাগোনা বন্ধ হওয়ায় এখানকার পাখিগুলো অবশ্যই আনন্দে থাকবে।” কিন্তু এ যুদ্ধ প্রকৃতিতে যে ক্ষতি করছে, তা পর্যটকদের আনাগোনায় হওয়া ক্ষতির চেয়ে মিলিয়ন (১০ লাখ) গুণ বেশি।’
সংরক্ষিত অভয়ারণ্য ‘আগামন হুলা ভ্যালি নেচার রিজার্ভ’ ইউরোপ ও এশিয়া থেকে আফ্রিকায় চলে আসা লাখ লাখ পাখির ‘বিশ্রামাগার’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবেই সুপরিচিত। শরৎ ও বসন্তকালে এসব পাখি আবার ফিরে যায় নিজ নিজ দেশে।
রুবিন বলছিলেন, ‘এটি পেলিকান (বড় আকৃতির জলচর পাখি), হাঁস, ইগল ও অন্যান্য শিকারি পাখির পাশাপাশি ফ্লেমিঙ্গোদের আবাসস্থল।’ তবে তিনি আরও বলেন, ‘আগের মৌসুমগুলোর চেয়ে এখন কম পাখি আসছে এখানে। অন্যান্য বছরের তুলনায় বাসাও বাঁধছে কম। কমে গেছে পাখির প্রজননও।’
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এ হামলার অজুহাতে সেদিন থেকেই গাজায় তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে গত বছর থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে থেমে থেমে ছোটখাটো হামলা শুরু করেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ।
(অভয়ারণ্যে পর্যটকদের আগমন বন্ধ হওয়ার পর) লোকজন আমাকে বলতেন, “বাহ্, মানুষের আনাগোনা বন্ধ হওয়ায় এখানকার পাখিগুলো অবশ্যই আনন্দে থাকবে।” কিন্তু এ যুদ্ধ প্রকৃতিতে যে ক্ষতি করছে, তা পর্যটকদের আনাগোনায় হওয়া ক্ষতির চেয়ে মিলিয়ন (১০ লাখ) গুণ বেশি।-ইনবার রুবিন, আগামন হুলা ভ্যালি নেচার রিজার্ভের মাঠ পরিচালক
পরে লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াইয়ে নামে ইসরায়েল। প্রায় এক বছর ধরে দুই পক্ষের মধ্যে আন্তসীমান্ত লড়াই চলার পর সম্প্রতি লেবাননের একেবারে ভেতর পর্যন্ত হামলা বিস্তৃত করেছে দেশটি। গাজা থেকে মনোযোগ খানিকটা কমিয়ে ইসরায়েল বর্তমানে লেবাননে হামলা জোরদার করেছে। বিমান হামলার পাশাপাশি, বিশেষত সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থল অভিযান চালাচ্ছে তারা।
ইসরায়েলি বোমা হামলায় এরই মধ্যে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লেবাননের অনেক গ্রাম। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে দক্ষিণ সীমান্তের এলাকাগুলো। এসব এলাকায় হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে বলে মনে করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে পক্ষীবিদ হিসেবে কাজ করছেন ইয়োসি লেশেম। ইন্টারন্যাশনাল বার্ড মাইগ্রেশন রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। বলছিলেন, ‘গত শীতে আগামন হুলা ভ্যালি নেচার রিজার্ভে প্রায় ৫০ হাজার সারস এসেছিল। আসলেই এটি ছিল এদের স্বর্গ।’
কিন্তু ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ শুরুর পর এ অভয়ারণ্যে সারসের আসা ৭০ শতাংশ কমে গেছে, জানাচ্ছিলেন লেশেম। বলছিলেন, ‘এ এক সত্যিকারের হুমকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি, যুদ্ধ যদি এক বছরের মধ্যে বন্ধও হয়ে যায়, তবু এর ক্ষতিকর প্রভাব রয়ে যাবে আরও অনেক বছর।’
এদিকে যুদ্ধের ক্ষতি শুধু এ অভয়ারণ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েলের প্রকৃতি ও পার্কবিষয়ক কর্তৃপক্ষের অনুমান, হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলজুড়ে প্রায় ৯২ হাজার ৪০০ একর (৩৭ হাজার ৪০০ হেক্টর) প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ভূমি, ন্যাশনাল পার্ক, বনাঞ্চল ও খোলা এলাকা পুড়ে গেছে।