ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফিলিস্তিনের গাজা। উপত্যকাটি পরিণত হয়েছে এক ‘নরকের কুণ্ডে’। এবার ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছে গাজা ছাপিয়ে পশ্চিম তীরেও। পাশাপাশি সেখানে নিয়মিতভাবে চালানো হচ্ছে হত্যাকাণ্ড, ধরপাকড় ও নির্যাতন-নিপীড়ন। গাজার মতো পশ্চিম তীরের শরণার্থীশিবির ও মসজিদও হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
এদিকে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত) গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ২৬৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১৭ জন শিশু।
গতকাল পশ্চিম তীরের জেনিন এলাকার একটি শরণার্থীশিবিরে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে শিবিরের একটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন অন্তত একজন। অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, মসজিদটির নিচে ভূগর্ভস্থ কক্ষে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের একটি ঘাঁটি ছিল।
এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (২০০০-২০০৫ গণ-অভ্যুত্থান) পর প্রথমবারের মতো পশ্চিম তীরের কোনো স্থাপনায় বিমান হামলা চালাল ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালে এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিম তীর দখল করে নেয় ইসরায়েল। বর্তমানে এই স্থানে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল—দুই পক্ষেরই সীমিত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আরব ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি রয়েছে অবৈধ ইসরায়েলি ইহুদি বসতিও।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর প্রতিদিনই পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান চলছে। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রামাল্লা, হেবরন, জেনিনসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অন্তত ৫৮ ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছে। এদিন অভিযানে নিহত হয়েছেন চার ফিলিস্তিনি। এ নিয়ে গত ১৬ দিনে সেখানে ১ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করল ইসরায়েল। আর এ সময়ে নিহত হয়েছেন ৯০ ফিলিস্তিনি।
‘লাশ এত বেশি, যে কাফনের কাপড়ও যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে থাকা লাশগুলো বোমার আঘাতে এতটাই থেঁতলে ও বিকৃত হয়ে গেছে যে চেনা যায় না।’ কথাগুলো বলছিলেন মধ্য গাজার দেইর আল বালাহ এলাকার আল-আকসা হাসপাতালের একজন চিকিৎসাকর্মী।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিরামহীন হামলায় প্রতিদিন এত ফিলিস্তিনি হতাহত হচ্ছেন যে এ হাসপাতালে তাঁদের রাখা বা ঠাঁই দেওয়ার জায়গা হচ্ছে না। লাশে হাসপাতালের হিমঘরগুলো ভরে গেছে। হাসপাতালের আঙিনায় সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হচ্ছে নতুন আসা লাশগুলো। একটি ছবিতে হাসপাতালের ভেতরে বেশ কয়েকটি শিশুর লাশ পাশাপাশি রাখতে দেখা গেছে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলসহ উপত্যকাটির বিভিন্ন স্থানে গতকালও ভয়াবহ বোমা হামলা চালানো হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় হামলায় ২৬৬ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১৭ জন শিশু। সংঘাত শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের বোমায় ৪ হাজার ৬৫১ জন নিহত হয়েছে। আহত ১৪ হাজার ২৪৫ জন। নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এদিকে এখন পর্যন্ত হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত ৫ হাজার ১৩২ জন।
গাজায় হামলা আরও জোরদার করার হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি। শনিবার রাতে তিনি বলেন, গাজার উত্তরাংশে (গাজা সিটি) এখনো যারা আছে, তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণে চলে যেতে হবে। যারা যাবে না তাদের হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।
অবরুদ্ধ গাজায় বিদ্যুৎ, পানি, খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে চলছে হাহাকার। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিশুদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। সেখানে রুটির দোকানের সামনে মানুষের লম্বা লাইন লেগে আছে। তবে সহজে রুটি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ময়দা ও বিদ্যুতের অভাব।
রুটির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইসরায়েলের নির্দেশে উত্তর গাজা থেকে খান ইউনিসে পালিয়ে আসা সালেহ এসকাফিও। তিনি বলেন, ‘আমরা চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছি। সেই ভোর থেকে রুটির জন্য অপেক্ষা করছি। শিশুরা অভুক্ত। পরিস্থিতি মর্মান্তিক।’
এমন দুর্দশার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যে এক চুক্তির জেরে প্রতিদিন গাজায় ২০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেছে। শনিবার মিসর সীমান্তের রাফাহ ক্রসিং দিয়ে প্রথম ২০ ট্রাক ত্রাণ পেয়েছে গাজার বাসিন্দারা। গতকালও তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছেছে। তবে জাতিসংঘ বলছে, এটি উপত্যকাটিতে প্রয়োজনীয় ত্রাণের ৪ শতাংশও না।
এদিকে গাজায় ত্রাণসহায়তা হিসেবে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। জাতিসংঘ বলছে, হাসপাতালগুলোয় জেনারেটর চালু রাখতে জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি প্রয়োজন। এর আগে গত সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস সতর্ক করে বলেছিল, বিদ্যুৎ ছাড়া গাজার হাসপাতালগুলো মর্গে পরিণত হবে।
গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান সংঘাতের মধ্যেই প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ছে ইসরায়েলের। গতকাল সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পো বিমানবন্দরে ইসরায়েল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। সিরিয়ার গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, হামলায় দুই বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। নিহত হয়েছেন দুজন।
এ ছাড়া ইসরায়েলের উত্তরে লেবাননের ভেতরে ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নানা স্থাপনা নিশানা করে শনিবার রাতভর হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলা হয়েছে গোষ্ঠীটির যোদ্ধাদের ওপরও। কয়েক দিন ধরেই হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটছে। এর জেরে গতকালও লেবানন সীমান্তের এলাকাগুলো থেকে নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয় ইসরায়েল। গাজা সীমান্তের মতো সেখানেও তৎপরতা বাড়াচ্ছে দেশটি।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন হুঁশিয়ারি দিয়ে লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতিকে বলেছেন, হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে লেবানন জড়ালে এর প্রভাব পড়বে দেশটির জনগণের ওপর।
অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদোল্লাহিয়ান গতকাল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েল যদি এখনই সামরিক তৎপরতা বন্ধ না করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।