ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত যা দেখছেন নেতানিয়াহু

ইশান থারুর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক একজন কলাম লেখক। ২২ জানুয়ারি লেখা এক কলামে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত অবসানে সম্প্রতি আবার আলোচনায় আসা ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ বিষয়ে ইসরায়েলের অবস্থান এবং এর সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি।

বছরের পর বছর ধরে ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ওকালতি করে আসছেন। তিনি ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে আসছেন, যে আন্দোলন এমনিতেই গাজার ‘ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন’ হামাস এবং পশ্চিম তীরের দুর্বল শাসকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। তদুপরি তিনি ইহুদি বসতি স্থাপনকারী এমন একটি অতি-ডানপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে মৈত্রী গড়েছেন, যারা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে আরও অসম্ভব করে তুলেছে।

এখন গাজায় হামাসকে শায়েস্তা করতে যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েল। এর মধ্যেই ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করতে নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সামাল দিতে হচ্ছে। ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ হলো পৃথক ভূখণ্ডের এক জোড়া রাষ্ট্রের দর্শন—একটি ইসরায়েলিদের জন্য এবং একটি ফিলিস্তিনিদের জন্য। এই দর্শন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে।

আরব সরকারগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি অর্থবহ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, তাহলেই কেবল তারা যুদ্ধের পরে গাজার পুনর্গঠন এবং স্থিতিশীলতার জন্য বিনিয়োগ করবে। এই যুদ্ধে ২৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার বেশির ভাগ এলাকাই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হোয়াইট হাউসও অন্ততপক্ষে মুখে হলেও ‘ফিলিস্তিনি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার’ কথা বলছে। তারা চায়, যুদ্ধোত্তর গাজা শাসন করবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)। এটা হবে দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইসরায়েলকে আরও সম্পৃক্ত করার বড় একটি সমঝোতার অংশ।

আবার আলোচনায় ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’

বাইডেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোপনে এই পরিকল্পনাটি ইসরায়েলি এবং আরব কর্মকর্তাদের কাছে উত্থাপন করেছেন। নেতানিয়াহুর সঙ্গে শুক্রবারের (১৯ জানুয়ারি) ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই রাষ্ট্র সমাধানের এমন একটি ধারণা সামনে এনেছিলেন, যেখানে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এটা কার্যত নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের সন্দেহকে স্বীকার করে নিচ্ছে। নেতানিয়াহুর সন্দেহ, স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হলে ইসরায়েল হুমকিতে পড়বে। নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দুই রাষ্ট্র সমাধান অসম্ভব কি না, শুক্রবার একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে বাইডেন বলেছিলেন, ‘না, এমনটা নয়।’

বাইডেনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানাতে বেশি সময় নেননি নেতানিয়াহু। শনিবার তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, ‘আমি জর্ডানের (নদীর) পশ্চিমের পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পুরোপুরি ইসরায়েলের হাতে রাখা নিয়ে আপস করব না। আর এটি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’ তাঁর এমন অবস্থান বাইডেনের আশাবাদী বক্তব্যকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

পরদিন হিব্রু ভাষায় দেওয়া এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু দুই রাষ্ট্র সমাধান ব্যর্থ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার জেদের কারণেই বছরের পর বছর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঠেকানো গেছে, যা ইসরায়েলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি তৈরি করতে পারত।’ নেতানিয়াহু বলেন, ‘যত দিন আমি প্রধানমন্ত্রী আছি, আমি বিষয়টির ওপর অব্যাহতভাবে জোর দিয়ে যাব।’

বাইডেনের সঙ্গে কথা বলার আগে বৃহস্পতিবারই হোয়াইট হাউসের প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করেন নেতানিয়াহু। যেকোনো সার্বভৌম ফিলিস্তিনি সত্তা ইসরায়েলের জন্য একটি অগ্রহণযোগ্য নিরাপত্তা হুমকি—এমন যুক্তি দিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘৩০ বছর ধরে আমি একই অবস্থান ধরে রেখেছি। আমি খুব সহজ কথাই বলছি।’ তিনি বলেন, ‘এই দ্বন্দ্ব একটি রাষ্ট্র তথা একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অভাব নিয়ে নয়; বরং একটি রাষ্ট্র তথা একটি ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতানিয়াহুকে সমর্থন জানিয়েছেন তাঁর ডানপন্থী জোট সরকারের একদল পার্লামেন্ট সদস্যও। হামাসের ৭ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করে নেতানিয়াহুর দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন তাঁরা। ইসরায়েলের সংস্কৃতি ও ক্রীড়ামন্ত্রী মিকি জোহর টুইট (বর্তমান এক্স) করেছেন, ‘আমি সবাইকে স্পষ্টভাবে বলছি, যাঁরা এখনো ৬ অক্টোবরে আটকে আছেন—আমরা কখনোই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেব না। হামলার শিকার শহীদ ও নিহত বীরদের প্রতি এটাই আমাদের অঙ্গীকার।’

একই স্লোগান নিয়ে ভিন্ন অবস্থান

‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত’ শব্দবন্ধ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করে দেশ দুটিতে ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভকারীরা জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও অধিকারের দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন। অনেক ইসরায়েলি এ দাবিকে তাঁদের রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সমার্থক বলে ভাবছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা হামাসের অতীতের বক্তৃতা–বয়ানের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের আইনপ্রণেতারা স্লোগানটিকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ অভিহিত করে আইন প্রণয়ন করেছেন।

তবে এই নদী ও সমুদ্রের মাঝখানে কিসের অস্তিত্ব থাকা উচিত, সে সম্পর্কে নেতানিয়াহু এবং তাঁর ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নিজস্ব অনড় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। লিকুদের আদি দলীয় মঞ্চ জোর দিয়ে বলে আসছে, ‘এই সাগর ও জর্ডানের (নদী) মধ্যকার ভূখণ্ডে কেবল ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব থাকবে।’ নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে একের পর গঠিত হওয়া সরকারগুলোর অধীনে ফিলিস্তিনি জনগণের একটি বড় অংশের ওপর ইহুদি আধিপত্য ও ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা গেড়ে বসেছে। এসব ফিলিস্তিনিদের জীবন ইসরায়েলের নিরাপত্তার বাধ্যবাধকতা মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এটি এমন একটি পরিস্থিতি, যা সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা। এমন সংস্থার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শনিবার (২০ জানুয়ারি) বলেছেন, ‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধান গ্রহণে অস্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনি জনগণের রাষ্ট্র পাওয়ার অধিকার অস্বীকার করা অগ্রহণযোগ্য। ফিলিস্তিনি জনগণের নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ার অধিকার অবশ্যই সবার দ্বারা স্বীকৃত হতে হবে।’

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেতানিয়াহুর সরকার যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখে, সে ক্ষেত্রে জোটের সম্ভাব্য পদক্ষেপের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সোমবারের (২২ জানুয়ারি) বৈঠক সামনে রেখে একটি নথি বিতরণ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাসেলস ইইউ সদস্যদের বলেছে, তাদের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনায় কেউ রাজি বা রাজি না হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা ঠিক করা উচিত।

ট্রাম্পের জন্য অপেক্ষা

পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে শুরু হওয়া নতুন বিক্ষোভের মধ্যে নেতানিয়াহু রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য লড়ছেন। ৭ অক্টোবরের হামলার আগে বিভাজনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করায় তাঁর সমালোচনা করে আসছেন অনেক ইসরায়েলি। গাজায় জিম্মিদের পরিবারগুলোর ব্যাপারে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত আচরণ নিয়েও ক্ষুব্ধ এই ইসরায়েলিরা।

ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের একজন নেতৃস্থানীয় রক্ষণশীল আইনপ্রণেতা নিউ ইয়র্কারের সম্পাদক ডেভিড রেমনিককে বলেছেন, ‘রাজনৈতিকভাবে নেতানিয়াহু নিজের মিস্টার সিকিউরিটি তথা নিরাপত্তাদাতার ভাবমূর্তি ফেরি করেছিলেন, কিন্তু ৭ অক্টোবর সেটা মুছে যায়।’ ওই আইনপ্রণেতা বলেন, ‘এখন তিনি জো হুজুর আমেরিকা। তিনি আমাদের ওপর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চাপিয়ে দেবেন। তিনি পুরোপুরি অবস্থান বদলে ফেলছেন। নিজের নিদারুণ ব্যর্থতার পর তাঁর একটি নতুন গল্প দরকার। তিনি একটি গল্প ফেরি করার চেষ্টা করছেন যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে, তিনি নন। আর তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে খারিজ করতে যাচ্ছেন।’

ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ। অনেকেই পরেছেন ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী কেফিয়াহ

একজন ধুরন্ধর হিসাবি নেতানিয়াহু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার একটি পথ খুঁজে নিতে পারেন। তিনি তাঁর বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরার সম্ভাবনা এবং ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষায় থাকার এ সময়ে যুদ্ধের ডামাডোল অব্যাহত রাখবেন। বরাবরের মতোই বাইডেন প্রশাসনের বামপন্থী সমালোচকেরা মনে করেন, হোয়াইট হাউস গাজার মর্মান্তিক ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত এবং নেতানিয়াহুর আপসহীন কঠোর ডানপন্থী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন ঠেকাতে পারছে না বললেই চলে।

সাবেক ইসরায়েলি শান্তি আলোচক দানিয়েল লেভি লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত হবে নেতানিয়াহু সরকারের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি এবং ক্ষমতাসীন জোটের লিখিত নীতিমালা আপসে মেনে নেওয়া। নীতিমালায় জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলের ভূমির সব অংশের ওপর ইহুদি জনগণের একচেটিয়া এবং অবিচ্ছেদ্য অধিকার রয়েছে।’ তিনি বলেন, এর পরিবর্ত ওয়াশিংটনের উচিত ইসরায়েলকে চেপে ধরা, যাতে তাদের নিয়ন্ত্রণে বসবাসকারী সবাইকে সমতা, ভোটাধিকার এবং অন্যান্য নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়ার একটি প্রস্তাব তৈরি করে।

ভাষান্তর: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম