ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে আজ মঙ্গলবারও তীব্র বোমাবর্ষণ করেছে ইসরায়েল বাহিনী। উত্তর গাজায় হাসপাতালগুলো ঘিরে চলছে আকাশ ও স্থলপথে হামলা। এমন পরিস্থিতিতে গাজার হাসপাতালগুলো রক্ষায় ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের আরজি, মানবিক বিবেচনায় উপত্যকাটিতে যেন যুদ্ধ স্থগিত রাখে ইসরায়েল। আর গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ‘গুরুতর’ বলে মনে করছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা।
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার পর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে নিহত হয়েছেন উপত্যকাটির ১১ হাজারের বেশি মানুষ। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আজ দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছেন। উত্তরের হাসপাতালগুলো বেহাল। সেখানকার সব হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে বলে গতকাল সোমবারই জানানো হয়েছিল।
এখনো উত্তর গাজায় অবস্থিত গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতালটি ট্যাংক দিয়ে ঘিরে রেখেছে ইসরায়েল বাহিনী। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাবে সেখানে শিশুসহ একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছেন। গতকাল থেকে হাসপাতালটির ৩২ রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল–কিদরা। হাসপাতালটিতে এখনো ৬৫০ রোগী ও হাজারে শরণার্থী রয়েছেন।
আল–শিফা হাসপাতালের অবস্থা কতটা শোচনীয়, তার একটি নমুনা দিয়েছেন হাসপাতালটির প্রধান মোহাম্মদ আবু সালমিয়াহ। আজ তিনি বলেন, ইসরায়েলের হামলার ভয়াবহতায় মারা যাওয়া ১৭৯ জনকে হাসপাতালটির চত্বরে গণকবর দিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। হাসপাতালে জ্বালানি শেষ হওয়ার পর মারা যাওয়া ৭ শিশু ও ২৯ রোগীকে সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে।
আল–শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলের নৃশংসতার মধ্যে প্রথমবারের মতো এ নিয়ে মুখ খুলেছেন বাইডেন। ইসরায়েলকে গাজার হাসপাতালগুলো রক্ষার আহ্বান জানিয়ে গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আশা করছি হাসপাতালগুলো ঘিরে তুলনামূলক কম অভিযান চালানো হবে। আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’ এদিকে গতকাল হোয়াইট হাউসে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। এ সময় তিনি বলেন, ‘গাজায় নৃশংসতা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া।’
বাইডেনের বিরুদ্ধে মামলা
ইসরায়েলের অভিযানের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে তুমুল ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও এতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা ঠেকাতে ব্যার্থতার অভিযোগ তুলে জো বাইডেনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা দ্য সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল রাইটস (সিসিআর)।
ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি আদালতে করা ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক ও মার্কিন আইন অনুযায়ী নিজের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মামলায় আদালতকে অনুরোধ করা হয়েছে, ইসরায়েলকে সমরাস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে যেন বিরত রাখা হয়। আর বাইডেন ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও যেন গাজায় ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যবস্থা নেন।
বেসামরিক নাগরিক রক্ষার তাগিদ সুনাকের
গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জোর আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করতে হবে। আর হাসপাতালসহ নিরপরাধ মানুষকে রক্ষায় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে পশ্চিম তীরে উগ্রবাদীদের সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মানবিক কারণে হামলা স্থগিত রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন সুনাক। একই সঙ্গে সেখানকার বেসামরিক বাসিন্দাদের সুরক্ষার দিকে যেন নজর রাখা হয়। গতকালও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সেনা অভিযানে ৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করলেন লুলা
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা গাজা উপত্যকায় ‘কোনো বাছবিচার ছাড়াই নিরপরাধ মানুষ হত্যা’ করার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি গতকাল বলেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ‘গুরুতর’ বলে মনে হচ্ছে। লুলা দা সিলভা বলেন, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের পাল্টা পদক্ষেপ হামাসের হামলার মতোই গুরুতর। ইসরায়েল কোনো বাছবিচার ছাড়াই গাজার নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করছে।
লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম এ দেশের নেতা সন্ত্রাসী, এমন অজুহাতে বিভিন্ন হাসপাতালে এবং শিশু রয়েছে এমন অনেক স্থানে বোমা হামলা চালানোয় ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করেন লুলা। তিনি বলেন, ‘এটি ব্যাখ্যাতীত। প্রথমে আপনাকে নারী ও শিশুদের বাঁচাতে হবে। তারপর আপনি যার সঙ্গে চান যুদ্ধ করুন।’
শর্তে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হামাসের
গাজায় অব্যাহত হামলা এবং উপত্যকাটির বেসামরিক লোকজনকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক আহ্বানের মধ্যেই ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটি গতকাল জানিয়েছে, ইসরায়েল পাঁচ দিন টানা যুদ্ধবিরতি দিলে জিম্মি করা সর্বোচ্চ ৭০ নারী ও শিশুকে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। হামাসের সামরিক শাখা আল কাসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দা একটি অডিও বার্তায় বলেন, এই যুদ্ধবিরতি হতে হবে পূর্ণমাত্রার এবং যুদ্ধবিরতির সময় গাজা উপত্যকার সবখানে ত্রাণসহ মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ থাকতে হবে।