ইরাক ও সিরিয়ায় ৮৫টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই লক্ষ্যবস্তুগুলোর সঙ্গে ইরানের এলিট ফোর্স ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড (আইআরজিসি) এবং বাহিনীটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করেছে ওয়াশিংটন। গত শুক্রবার চালানো এসব হামলায় প্রায় ৪০ জন নিহত হয়েছেন।
জর্ডানে মার্কিন ঘাঁটিতে গত রোববার হামলায় তিন সেনা নিহতের ঘটনার জবাবে প্রথম এ হামলা চালাল যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এ হামলা ইতিমধ্যে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে কেন্দ্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থির করে তুলবে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত বয়লারের সঙ্গে তুলনাও করে কেউ কেউ বলছেন, যেকোনো সময় এর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
জর্ডানে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার সঙ্গে ইরানপন্থী একটি গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এর জবাবে ইরানের স্থাপনার হামলার ঘোষণা আগেই গিয়ে রেখেছিল ওয়াশিংটন। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এমন হামলা আরও চালানো হবে।
গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর জের ধরে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে দুই দেশে ইরানের স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা চলমান পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলল।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকেই হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে ইরান। হামলা বন্ধে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে ইরানসমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। আর শুক্রবার হামলার পর এক বিবৃতিতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা দেশটির কৌশলগত আরেকটি ভুল। এর মধ্যে শুধু উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতাই বাড়বে। আর হামাস বলেছে, এই হামলা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো।
ইরাকে হামলার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাগদাদ। এ হামলার মাধ্যমে ইরাকের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে নিন্দা জানিয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্টের কার্যালয়। বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ইরাকের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, হামলায় তাদের ১৬ সদস্য নিহত হয়েছেন।
শুক্রবারের হামলায় সিরিয়ায় ২৩ জন নিহত হয়েছেন। হামলার নিন্দা জানিয়ে সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও বাড়িয়ে তুলবে।
সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ‘উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য হারে’ বেড়েছে বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেসের জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক নীতি বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যালিসন ম্যাকমানুস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে উত্তেজনা এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত বয়লারের মতো, যেকোনো সময় এর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
গাজায় সংঘাত শুরুর পর লেবানন, ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থান করা ইরান–সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না জড়ানোর কথা বারবার বলে আসছে তেহরান। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় পরিসরে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক, তা চান না বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও।
শুক্রবারের হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জবাব দেওয়া শুরু করল। তবে মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য কোথাও সংঘাত চায় না ওয়াশিংটন।
ইরাক ও সিরিয়ায় হামলার আগে শুক্রবারেই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছিলেন, তাঁর দেশ কোনো যুদ্ধ শুরু করতে চায় না। তবে কোনো হামলা চালানো হলে তার ‘শক্ত জবাব’ দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার ইরাক ও সিরিয়ার কমান্ড সেন্টার এবং রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের মজুতাগার লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। মাত্র ৩০ মিনিটের অভিযানে ৮৫টি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এসব হামলা সফল হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট স্টাফের পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডগলাস সিমস। হামলার পর জো বাইডেন বলেছেন, ‘আজ থেকে আমাদের জবাব দেওয়া শুরু হলো। আমাদের পছন্দের সময়ে ও স্থানে হামলা চলতে থাকবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে এসব হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের ঘাঁটিগুলো সুরক্ষিত করতে চাইছে। ৭ অক্টোবর থেকে জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন সেনাসদস্যদের ওপর ১৬০ বারের বেশি হামলা হয়েছে। জবাবে আগেও পাল্টা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই হাজার ও সিরিয়ায় ৯০০ সেনা অবস্থান করছেন।
তবে শুক্রবারের হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনারা কতটা সুরক্ষিত হবেন বা এ অঞ্চলে আরও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে কি না, তা শিগগিরই জানা যাবে বলে মনে করেন বিবিসির সংবাদদাতা টম বেটম্যান। তিনি বলেন, ইরানের ভূখণ্ডের বাইরে দেশটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপরে হামলা যে পরিকল্পনা বাইডেন করেছেন, তা তেহরানের মিত্রদের পিছু হটাবে, নাকি সংঘাত আরও বাড়িয়ে তুলবে, তা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই জানা যাবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিন্তনগোষ্ঠী রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সামরিক বিশ্লেষক এইচ এ হেলারের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যদি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে চায় ও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে চায় তাহলে মূল প্রসঙ্গ হলো গাজা। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি আনতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে হলে গাজায় হামলা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে।