অনাগত সন্তানকে নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন নিভিন আল-বারবারি। গাজায় এই অমানবিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে তিনি আতঙ্কিত। গাজায় প্রতিটি ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় ৩৩ বছর বয়সী নিভিনের পিঠ-পেট ভয় ও ব্যথায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলের হামলা শুরুর আগে নিভিন নিয়মিত একজন চিকিৎসকের কাছে যেতেন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করাতেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত বোমা হামলার কারণে এখন তা আর করাতে পারছেন না। বাড়িতে বন্দী থাকতে বাধ্য হতে হচ্ছে তাঁকে। চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনো উপায় নেই তাঁর।
নিভিন আল-বারবারি বলেন, ‘সন্তানের কোথায়, কীভাবে জন্ম দেব, এই নিয়ে প্রতিদিন ভাবছি। বোমা হামলা থামছে না। মানুষ, গাছ বা পাথর কেউই এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কার বাড়ি ধ্বংস হবে বা কার মৃত্যু হবে, তা আমরা জানি না। আমার কেবল একটাই চাওয়া, আমার সন্তান যেন নিরাপদে থাকে।’
চলতি মাসেই প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন নিভিন। গাজা উপত্যকায় গর্ভধারণের শেষের দিকে আছেন এমন হাজারো নারীর মধ্যে নিভিন একজন।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনপিএফ) তথ্য অনুসারে, অবরুদ্ধ গাজা অঞ্চলে ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী আছেন। ইসরায়েলের হামলা-অবরোধের কারণে গাজার স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ কারণে গর্ভবতী নারীদের অনেকেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ চিকিৎসার অভাবে ভুগছেন। গাজায় গত সপ্তাহে ইউএনপিএফ গর্ভবতী নারীদের জন্য ‘জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা’র ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছে।
নিভিন বলেন, ‘ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা বা আহত অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে থাকা শিশুদের ছবি দেখে আমি নিজের অনাগত সন্তানের জন্য খুব ভয়ে আছি। অনাগত সন্তানকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষার জন্য রোজ আমি যুদ্ধ বন্ধে প্রার্থনা করি। কিন্তু কারও কোনো দয়া হয় না।’
খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ওয়ালিদ আবু হাতাবের মতে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। গত দুই সপ্তাহে এই উপত্যকার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ওয়ালিদ আবু হাতাব আল–জাজিরাকে বলেন, অনেক নারী ঘর হারিয়ে, বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এর অর্থ তিনি আর আগের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে নেই। অথচ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রই তাঁর শারীরিক অবস্থা শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিল। এ কারণে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া তাঁদের জন্য বেশ কঠিন। গর্ভাবস্থার বিভিন্ন সময় প্রাথমিক যত্ন এবং নিয়মিত ফলোআপ সেশনের প্রয়োজন হয়।
ইসরায়েলের বোমা হামলার কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে উত্তর গাজা ও গাজা শহর ছেড়ে দক্ষিণে চলে গেছে। তাদের কেউ কেউ আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে, কেউবা জাতিসংঘ পরিচালিত ছোট্ট স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।
এই পরিস্থিতিকে ‘স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়’ হিসেবে বর্ণনা করে চিকিৎসক আবু হাতাব বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।
সুআদ আসরাফ ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এবার তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম হবে। গাজা শহরের শাতি শরণার্থীশিবির থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিসে জাতিসংঘের একটি স্কুলে এখন তাঁকে আশ্রয় নিতে হয়েছে। বারবার এই বাস্তুচ্যুতির কারণে তিনি ভীষণ অবসাদ ও ক্লান্তিতে ভুগছেন।
২৯ বছর বয়সী সুআদ আসরাফ বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ঘুমের অভাব আর ভয়ে আমি ক্লান্ত। আমাকে আমার অন্য দুই সন্তানের যত্ন নিতে হবে, কিন্তু এই আশ্রয়কেন্দ্রে (স্কুলে) পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা নেই। নোনা পানি খেতে বাধ্য হয়েছি। এই পানি আমি সহ্য করতে পারি না। এ ছাড়া এটা আমার গর্ভাবস্থার চাপকেও প্রভাবিত করে।’
প্রতিনিয়ত এই ভয়ের কারণে পেটে অনাগত সন্তান ঠিক আছে কি না, তা জানতে চান সুআদ আসরাফ। তিনি বেশ কয়েকবার শাতি ক্যাম্পের জাতিসংঘ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু একবারও কথা বলতে পারেননি।
আশ্রয়কেন্দ্রে সঠিক পুষ্টি ও যত্ন নেই বলে সুআদ সব সময় ক্লান্তি এবং বমি বমি ভাব অনুভব করেন। এই আশ্রয়কেন্দ্রে উপচে পড়া মানুষের ভিড়। চারদিকে চিৎকার। এ কারণে ৩০ মিনিটের বেশি ঘুম বা চোখ চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন না তিনি।
সুআদ বলেন, ‘এখানে তিনজন গর্ভবতী নারী আছেন। তাঁদের অবস্থাও আমার মতোই। দুই দিন আগে, তাঁদের মধ্যে একজন জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আমরা তাঁকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।’
কোনো কোনো নারী টেস্টটিউব বেবির জন্ম পদ্ধতি (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন—আইভিএফ) গ্রহণ করেছেন। তাঁদের অনেকেই গর্ভপাতের আশঙ্কায় আছেন।
লায়লা বারাকা নামের ৩০ বছর বয়সী নারী দ্বিতীয় সন্তানের জন্য বছরের পর বছর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। শেষমেশ তিনি আইভিএফ পদ্ধতি সফলভাবে গ্রহণ করেছেন। এখন তিনি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
লায়লা বলেন, ‘দিন-রাত সব সময় আমি বোমা বিস্ফোরণের শব্দে ভয় পাই। রাতে এই শব্দ আরও ভয়ংকর মনে হয়। ভয়ে আমি আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু এতে ভয় কমে না। আমরা যা শুনছি, তাতে শুধু মানুষ নয়, পাথরও ভয় পাবে।’
লায়লা খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চলীয় শহর বানি সুহাইলা থেকে এসেছেন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি বড় শহর ছেড়ে এসেছেন। কিন্তু ইসরায়েলি সীমান্তের কাছাকাছি ওই এলাকার সবাই প্রাণ ভয়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে। তিনি আগে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত যেতেন, এখন সেখানে ফোন দিয়ে তিনি কোনো সাড়া পাচ্ছেন না।
লায়লা বলেন, ‘এমনকি আমার চিকিৎসকও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা এখন খুব কঠিন। তবে আমি ভাগ্যবান যে আমার মা সব সময় আমার পাশে আছেন। মা নানা উপায়ে আমাকে আশ্বস্ত করার ও চাপ অনুভব কমানোর চেষ্টা করছেন।’ তবে এসব টোটকা উপায় লায়লার ক্ষেত্রে খুব কম কাজ করে। খবরে নিহত শিশুদের ছবি ও ভিডিও দেখতে দেখতে তিনি এখন ক্লান্ত।
৭ অক্টোবর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত শুরু হয়। ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের দুই-তৃতীয়াংশই শিশু ও নারী।
গাজা উপত্যকায় হামলার কারণে প্রধান প্রধান সড়ক ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণে গর্ভবতী নারীদের সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে পৌঁছাতে যে সময় লাগত, সে সময় এখন আরও বেশি লাগবে। আগে গাড়িতে মাত্র কয়েক মিনিটে হাসপাতালে যাওয়া যেত। আর এখন তা কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এতে নারীদের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে।
চিকিৎসক আবু হাতাব বলেন, ‘অন্য দিন একজন নারীর একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তাঁর প্রসবের কথা ছিল, অনেক রক্তপাত হয়েছিল। তিনি নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে যেতে দুই ঘণ্টা ধরে রাস্তায় ছিলেন। অনেক চেষ্টার পর আমরা তাঁর রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। তাঁর জীবন বেঁচে গেছে।’
ইসরায়েল ক্রমাগত হাসপাতালগুলোতেও হামলার হুমকি দিয়েছে। ফিলিস্তিনি পরিবার পরিকল্পনা এবং সুরক্ষা সংস্থার মতে, আসছে মাসগুলোতে গাজায় ৩৭ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারীকে বিদ্যুৎ বা চিকিৎসা সরবরাহ ছাড়াই সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য করা হবে। জরুরি প্রসূতি পরিষেবার সংকটের কারণে তাঁদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
আবু হাতাব বলেন, ‘গর্ভবতী নারীদের কাছ থেকে কয়েক ডজন ফোনকল পেয়েছি। তাঁরা জানিয়েছেন, হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ইনসুলিন ও রক্ত পাতলা করার চিকিৎসা দিতে তাঁরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে পারছেন না। স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা–সংকটের কারণে তাঁদের জীবন হুমকির মুখে। তাঁদের মৃত্যুও হতে পারে—এটা নিয়েই আমরা এখন উদ্বিগ্ন।’