কাতারও যেভাবে বিশ্বকাপ জিতল

লিওনেল মেসিকে সোনার ঝালরবিশিষ্ট একটি বিশেষ গাউন পরিয়ে দেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি
ছবি: রয়টার্স

আরব উপদ্বীপের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ কাতার। নিজ নাগরিকের সংখ্যা চার লাখেরও কম। এই দেশই সফলভাবে শেষ করল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত ক্রীড়া জগতের অন্যতম সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের। স্বাগতিক দল হিসেবে কাতার বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করলেও, সফল এই আয়োজনে দেশটিকে কৃতিত্ব দিতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না কেউই। নিউইয়র্ক টাইমসে তারিক পাঞ্জার লেখা ‘নিজেদের প্রত্যাশিত বিশ্বকাপ পেল কাতার’ নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে কাতারের এই সাফল্যের কথা।

২০০৯ সালে যখন কাতার এই আসর আয়োজনের অসম্ভব প্রতিযোগিতায় নামে, তখন বিশ্বমঞ্চে নিজেকে আরও ভালোভাবে পরিচিত করা ছাড়া দেশটির বেশি কিছু প্রত্যাশা ছিল না। সম্পদ, সময় এবং জীবন—এসব বিবেচনায় এই আসর আয়োজনের পেছনে যথেষ্ট ব্যয় করেছে কাতার।

গতকাল রোববার রাতে আতশবাজির আলোয় যখন লুসাইলের রাতের আকাশ বর্ণিল হয়ে উঠল তখন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা গাইছিলেন। সে সময় তাঁদের আজীবন আরাধ্য শিরোপাটি হাতে তুলে নেওয়ার অপার আনন্দের আভা তাঁদের  চেহারায় ফুটে উঠছিল। সে সময় কাতারের নামটিও যেন বিশ্বকাপ ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল।

বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা ঠিক তা-ই পেয়েছেন, যা চেয়েছিলেন

জমকালো উদ্‌যাপনে আড়ালে বিতর্ক

ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার স্বপ্নের ফাইনাল; বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় মেসির প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা; একটি স্পন্দিত ম্যাচ ছয় গোল ও পেনাল্টি শুটআউটে গিয়ে নিষ্পত্তি- সবকিছু মিলিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সমাপনী ছিল চোখধাঁধানো।
চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের আভা নিয়ে মেসি যখন ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বড় শিরোপা হাতে নিতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে থামালেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি। মধ্যপ্রাচ্যে আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপে জাতির চূড়ান্ত স্মৃতিচিহ্ন এঁকে দেওয়াটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছিলেন।

শেখ তামিম সোনার ঝালরবিশিষ্ট একটি পাতলা গাউন বের করলেন। সাধারণত উপসাগরীয় অঞ্চলে বিশেষ অনুষ্ঠানে এ কালো পোশাকটি পরা হয়। ১৮ ক্যারেটের সোনার শিরোপাটি হাতে তুলে দেওয়ার আগে বিশেষ গাউন তিনি মেসিকে পরিয়ে দেন।

গত এক দশকের সব বিতর্কের ইতি টেনেছে এই উদ্‌যাপন। কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে বিতর্ক কম ছিল না। ছিল আয়োজক দেশ হতে ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিশ্বকাপ ঘিরে কাতারে ২০ হাজার কোটি ডলারের নির্মাণ প্রকল্পে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার অভিযোগও ছিল। মদ্যপান ও এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠীর সমর্থনে হাতে ব্যান্ড পরাও নিষিদ্ধ ছিল।

লিওনেল মেসির স্বপ্নজয়ের অংশ হয়ে গেল কাতার নামটিও

তবুও এক মাস ধরে কাতার বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। আরব বিশ্বে দেশটির প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউই এমন কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনি। অথচ কাতার ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করবে—২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর জুরিখে কনফারেন্স হলে ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের বিস্ময়কর ঘোষণার পরের বছরগুলোতে কখনো কখনো বিষয়টি কল্পনাতীত বলে মনে হয়েছিল।

বিশ্বকাপে বিপুল ব্যয়

বিশ্বকাপের মতো আসর আয়োজনের জন্য কাতার সম্ভবত সবচেয়ে অনুপযুক্ত দেশগুলোর একটি ছিল। অপর্যাপ্ত খেলার মাঠ, অবকাঠামো এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় কাতারের মতো দেশকে আয়োজক হিসেবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলেছিলেন খোদ ফিফার নিজস্ব মূল্যায়নকারীরা। কিন্তু এসবে কান না দিয়ে কাতার প্রচুর অর্থব্যয় করেছে।

এক মাসের ফুটবল আসরের জন্য পুরো দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার চেয়ে কম কিছু করেনি কাতার। দেশের ভেতর শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে। প্রচুর অর্থ ও জীবনের বিনিময়ে সাতটি নতুন খেলার মাঠ নির্মাণ করেছে।  গড়ে তুলেছে অন্যান্য অবকাঠামো।  দেশের বাইরেও বেহিসাবে টাকা ঢালতে থাকে দেশটি। শত শত কোটি ডলারে কিনে নেয় ফুটবল ক্লাব ও ক্রীড়া স্বত্ব। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজে লাগানো হয় ক্রীড়া জগৎসহ অন্যান্য তারকাদেরও।

আর রোববার এসব কিছুই প্রদর্শন করা হয়। যখন ১০০ কোটি ডলারের লুসাইল স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলা চলছিল, তখন কাতারের হারানোর কিছু ছিল না। খেলাটি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দেখিয়েছে বিআইএন স্পোর্টস। বিশ্বকাপ আয়োজনের যোগ্যতা অর্জনের পর কাতার এই বিশাল ক্রীড়া সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। এমনকি মাঠের দুই সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পেকেও নিজেদের দাবি করতে পারে দেশটি। দুজনই খেলেন কাতারের মালিকানাধীন ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই-পিএসজিতে।

আরব ফুটবলের উত্থান

মাঠেও এবারের বিশ্বকাপে ছিল নানা নাটকীয়তা। দুর্দান্ত গোল আর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ। হতবাক করে দেওয়ার মতো অঘটন। অনেক খেলার গোলের সংখ্যায়ও ছিল বিস্ময়। বেশ কয়েকজন তারকা খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়েছে এই বিশ্বকাপ, তাদের অধিকাংশই আরব বিশ্বের।

প্রথমেই আসে সৌদি আরবের কথা। গ্রুপ পর্বে তারা হারিয়েছিল এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। এরপর আসে মরক্কোর কথা। প্রথম কোনো আফ্রিকান দেশ হিসেবে তারা ফুটবল বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলেছে। এই স্বপ্নযাত্রায় তারা হারিয়েছিল ইউরোপীয় ফুটবল জায়ান্ট বেলজিয়াম, স্পেন ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে। আরব বিশ্বের পাশাপাশি ইউরোপের কিছু দেশের রাজধানীতেও সমর্থকদের এই ফলাফল উদ্‌যাপন করতে দেখা যায়।

কয়েকটি ম্যাচে দর্শক গ্যালারিতে আসন ফাঁকা ছিল। বিনা মূল্যে খেলা দেখার সুযোগ করে দিয়ে ওই সব ম্যাচে গ্যালারি পূর্ণ করা হয়েছিল। এসব দর্শকদের অধিকাংশই ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসী। এসব খেলার মাঠ তৈরিতে যেসব অভিবাসী শ্রমিক কাজ করেছিলেন, তাঁদেরই বিনা টিকিটে খেলা দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল।

দর্শকদের এই দল মূলত ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মতো দেশগুলো থেকে আসা। খেলা দেখতে আসা ১০ লাখ দর্শকের মধ্যে কাতারে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছিল এই মুখগুলো। তাঁরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন, খাবার পরিবেশন করেছিলেন এবং মেট্রো স্টেশনগুলো পরিচালনা করেছিলেন।

খেলার শেষ দিকে অধিকাংশ দর্শকই চলে যান। বাকি ছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা, প্রায় ৪০ হাজারের মতো। তাঁরা ফাইনাল ম্যাচ মাতিয়ে রেখেছিলেন। আকাশি-নীল ও সাদা জার্সিতে তাঁরা লুসাইলে জড়ো হয়েছিলেন।

১২০ মিনিটের খেলা চলকালে এবং এর অনেকক্ষণ পরেও নেচে-গেয়ে তৈরি করেছিলেন নিখাদ বিশ্বকাপের আবহ। বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা ঠিক তা-ই পেয়েছেন, যা চেয়েছিলেন। যেমনটা পেয়েছে কাতারও।