দক্ষিণ ইসরায়েলে গত ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়ে দুই শতাধিক মানুষকে বন্দী করে নিয়ে যায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাতার সরকার। তারা হোয়াইট হাউসকে একটি ছোট উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে বলে, যারা হামাসের হাতে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির বিষয়ে কাজ করবে।
বন্দীদের ধরে নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই কাতারের এই উদ্যোগে কাজ হয়। প্রায় দেড় মাস আলোচনার পর অবশেষে বন্দীদের হস্তান্তরে একটি চুক্তির ঘোষণা আসে। কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় চুক্তিতে রাজি হয় ইসরায়েল, হামাস ও যুক্তরাষ্ট্র।
অত্যন্ত গোপনীয় এই উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও ছিল। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কাতারের আমির ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেন তিনি।
জো বাইডেনের কূটনৈতিক উদ্যোগে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, সিআইএ পরিচালক বিল বার্নস, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ও তাঁর ডেপুটি জন ফিনার এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দূত ব্রেট ম্যাকগারকসহ অনেকে। বন্দীদের মুক্ত করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তাঁরা।
এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত দুজন কূটনীতিক এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছেন।
ওই কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, ৭ অক্টোবরের হামলার পর বন্দীদের সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্য ও তাদের কীভাবে মুক্ত করা যায়, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাতার। কাতার একটি ছোট দল গঠন করতে বলেছিল, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী যা একটি ‘সেল’। এ দলটি ইসরায়েলের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করবে।
জ্যাক সুলিভান, ম্যাকগারক ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের আরেক সদস্য জশ গেলৎজারকে দল গঠনের নির্দেশ দেন। এটি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থার অগোচরেই। কারণ, কাতার ও ইসরায়েল চেয়েছিল কাজটি যেন অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়।
এ চুক্তিটি আমাদের প্রয়োজন।বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ম্যাকগারকের ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি প্রতিদিন সকালে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মেদ বিন আবদুলরহমান বিন জসিম আল-থানির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতেন। আলাপ-আলোচনার পর জ্যাক সুলিভান ও জো বাইডেনকে প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানান।
হামাসের হাতে বন্দী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ১৩ অক্টোবর একটি বৈঠক করেন বাইডেন। ওই বৈঠকের পর বন্দীদের মুক্ত করতে আরও উদ্যোগী হন বাইডেন।
এর কয়েক দিন পর ১৮ অক্টোবর ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব সফরে যান জো বাইডেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, সফরকালে নেতানিয়াহু ও তাঁর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে বৈঠক করেন বাইডেন। ওই বৈঠকের আলোচ্য বিষয়ে ছিল, কীভাবে বন্দীদের নিরাপদে মুক্ত করা যায়। বৈঠকে মানবিক সহায়তার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছিল।
জো বাইডেনের ইসরায়েল সফরের পাঁচ দিন পর ২৩ অক্টোবর বন্দীদের মুক্ত করতে সাফল্য অর্জন করে হোয়াইট হাউসের দলটি। ওই দিন হামাসের হাতে বন্দী দুজন মার্কিন নাগরিক নাতালিয়া ও জুডিথ রানানকে মুক্তি দেয় হামাস।
ওই দুই কূটনীতিক বলেন, মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি দেওয়া প্রমাণ করে, বাকি বন্দীদেরও হামাসের কাছ থেকে বের করে আনা সম্ভব। এটি বাইডেনের আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দেয়। তিনি মনে করেন, ছোট দলের মাধ্যমে কাতার বন্দীদের মুক্ত করতে পারবে।
জ্যাক সুলিভান একটি দল গঠনের নির্দেশ দেন। এটি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থার অগোচরেই। কারণ, কাতার ও ইসরায়েল চেয়েছিল জিম্মি মুক্তির উদ্যোগটি যেন অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়।
অন্য বন্দীদের কীভাবে মুক্ত করা যায়, সেটি নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়। দুজন মার্কিন নাগরিককে ছেড়ে দেওয়ার পর ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পরিচালক ডেভিড বার্নিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলা শুরু করেন সিআইএ পরিচালক বিল বার্নস।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, বাইডেন বড়সংখ্যক বন্দীকে মুক্তির একটি সুযোগ দেখেছিলেন। তবে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার চুক্তি করাই যুদ্ধবিরতির একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ।
হামাসের হামলার ১৭ দিন পর ২৪ অক্টোবর গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নেয় ইসরায়েল। তবে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারে, হামাস বন্দী নারী ও শিশুদের মুক্তি দিতে একটি চুক্তি করতে চায়।
এমন পরিস্থিতিতে স্থল অভিযান চালানো হবে, নাকি দেরি করা হবে—তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক হয়।
ইসরায়েল যুক্তি দেখায়, চুক্তির শর্তগুলো স্থল অভিযান চালাতে দেরি করার মতো যথেষ্ট পোক্ত নয়। তা ছাড়া বন্দীদের বেঁচে থাকারও কোনো প্রমাণ নেই। এদিকে হামাস দাবি করে, যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত বন্দীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেবে না তারা।
সম্ভাব্য বন্দী মুক্তির প্রস্তাব নিয়ে পরবর্তী তিন সপ্তাহ লেগে থাকেন জো বাইডেন। পাশাপাশি হামাসের কাছে থাকা বন্দীদের একটি তালিকা প্রকাশ, তাদের শনাক্ত করার মতো তথ্য ও তাদের মুক্তির নিশ্চয়তা দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি শুরু হলে কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গোপনে কথা বলেন জো বাইডেন।
চুক্তি অনুযায়ী বন্দী ৫০ নারী ও শিশুকে প্রথম ধাপে মুক্তি দিতে বলা হয়। বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী ১৫০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
প্রথম ধাপে সব নারী ও শিশুকে মুক্তি দিতে হামাসের প্রতি জোর দিয়েছে ইসরায়েল। তাদের এই প্রস্তাবে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই হামাসের কাছে বন্দী নারী ও শিশুদের জীবিত থাকার প্রমাণ দিতে কাতারের কাছে দাবি জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
হামাস জানায়, তারা প্রথম ধাপে ৫০ জনকে মুক্তি দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারবে। তবে বন্দীদের তালিকা দিতে রাজি হয়নি তারা। এমন অবস্থায় ৯ নভেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় দেশটির শীর্ষ নেতা ও মোসাদের পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন সিআইএ পরিচালক বার্নস। বৈঠকে বন্দী মুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তবে, হামাস বন্দীদের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ দিতে রাজি না হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।
এর তিন দিন পর কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানিকে ফোন করেন জো বাইডেন। এ সময় হামাসের হাতে থাকা ৫০ বন্দীর নাম, বয়স, লিঙ্গ এবং জাতীয়তা প্রকাশের দাবি জানান তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব তথ্য ছাড়া সামনে এগোনোর কোনো ভিত্তি নেই।
বাইডেনের ওই ফোনের পরপরই ৫০ বন্দীর একটি বিস্তারিত তালিকা তৈরি করে হামাস।
এরপর ১৪ নভেম্বর নেতানিয়াহুকে ফোন করে চুক্তিতে রাজি হতে বলেন বাইডেন। একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই দিনই নেতানিয়াহুর সঙ্গে ইসরায়েলে দেখা করেন ম্যাকগারক। এ সময় নেতানিয়াহু তাঁকে বলেন, ‘এ চুক্তিটি আমাদের প্রয়োজন।’ একই সঙ্গে চুক্তির শর্তগুলো চূড়ান্ত করতে কাতারের আমিরকে ফোন দিতে বাইডেনকে অনুরোধ করেন তিনি।
ওই সময় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্মেলনে যোগ দিতে সান ফ্রান্সিসকো যান জো বাইডেন। দুই কর্মকর্তা বলেন, বাইডেন কাতারের আমিরকে ফোন করে বলেন, এটাই শেষ সুযোগ। চুক্তি চূড়ান্ত করতে হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে রাজি হন কাতারের আমির।
এরপর গত শনিবার দোহায় কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ম্যাকগারক। অন্যদিকে বার্নস মোসাদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই সাক্ষাতে চুক্তির ফাঁকফোকর নিয়ে আলোচনা করা হয়।