ইসরায়েলের বোমা হামলায় বিধ্বস্ত গাজা

বোমা হামলায় আট শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত। ইসরায়েলের অবরোধ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

কয়েক দিন আগেও এখানে ছিল অনেক বহুতল ভবন। ইসরায়েলি বাহিনীর টানা চার দিনের বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেগুলো। গতকাল মঙ্গলবার ফিলিস্তিনের গাজা শহরে
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলা চলছে। অব্যাহত হামলায় জনবহুল গাজা রূপ নিয়েছে বিধ্বস্ত এক জনপদে। হাসপাতালগুলোতে মরদেহ রাখার জায়গা হচ্ছে না। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছাড়লেও পাচ্ছেন না নিরাপদ আশ্রয়। সেখানে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। একই সঙ্গে গাজাবাসীর কাছে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ করে দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, টানা চার দিনের ইসরায়েলি বোমা হামলায় অন্তত ৮৩০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন চার হাজারের বেশি মানুষ। অপর দিকে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে বলে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত শনিবার সকালে গাজা থেকে ইসরায়েলে কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। একই সঙ্গে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করেন হামাস যোদ্ধারা। এরপর তিন দিন ওই যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী গতকাল বলেছে, তারা দেড় হাজার হামাস সদস্যকে হত্যা করেছে। পাশাপাশি গাজা সীমান্তবর্তী সব এলাকায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

হামাস ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। ইসরায়েলে ঢুকে হামাস যেভাবে নির্বিচার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে, তার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়ে যেভাবে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

অসহায় গাজাবাসী

ইসরায়েলের বাহিনী সোমবার রাতে যুদ্ধবিমান থেকে গাজায় ২০০ লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছে। এরপরও বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে তারা। প্রত্যক্ষদর্শী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকেরা বলছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের এই ৭৫ বছরের মধ্যে গাজায় এর আগে কখনো এত বেশি বোমা হামলা হয়নি।

টানা হামলার মুখে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। তবে যেখানেই যাচ্ছেন, হামলার শঙ্কা থাকছেই। কারণ, বাছবিচার ছাড়াই বোমা ফেলছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার কেন্দ্রস্থলের নিকটবর্তী যে আবাসিক এলাকা মানুষের পদচারণে মুখর থাকত, সেটি এখন বিধ্বস্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। ভবনগুলো সব ধসে পড়েছে।

ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে জামাল আল জিনাতির বাড়ি। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে। ধ্বংসযজ্ঞ কত ভয়াবহ, তার বর্ণনা দিয়ে জামাল বলেন, ‘বাড়ি বলতে আর কিছু নেই। সব মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর এসে উঠেছি এই স্কুলে। এখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। শত শত মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘুমানোর মতো জায়গা নেই। বাচ্চারা সারাক্ষণ কাঁদছে।’

গাজার বাসিন্দা মারার হুমাইদ। চার সন্তান নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) রাতভর হামলা হয়েছে। তিন দিন ধরে এভাবে রাতজুড়ে হামলা হচ্ছে। আমি, আমার শিশুসন্তান, মা–বাবা, ভাইবোন, ভাতিজা–ভাতিজিরা সারা রাত অন্ধকারের মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে জেগে ছিলাম। চারপাশ থেকে ভেসে আসছিল একের পর এক বোমাবর্ষণের শব্দ।’

হাসপাতালে মরদেহ রাখার জায়গা নেই

গাজার খান ইউনিস হাসপাতালের মর্গ। স্ট্রেচারে পড়ে রয়েছে মরদেহ। প্রতিটি মরদহের বুকে লেখা রয়েছে মৃত ব্যক্তির নাম। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা আহ্বান জানাচ্ছেন, স্বজনেরা এসে যেন এসব মরদেহ নিয়ে যান। কারণ, হাসপাতালে মরদেহ রাখার জায়গা নেই।

সেই হাসপাতালের এক অংশে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন ৩৫ বছর বয়সী আলা আবু তাইর। তিনি বলেন, ‘অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছেন। আমার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কেউ কেউ। গাজার কোনো স্থান এখন আর নিরাপদ নয়। দেখতেই পাচ্ছেন, সর্বত্র হামলা চলছে।’

গাজা থেকে আল–জাজিরার সাংবাদিক ইয়োমনা এলসায়েদ বলেন, স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। গাজার হাসপাতালগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। এখানকার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল শিফা হাসপাতাল। কিন্তু এখানে এত মরদেহ ও আহত মানুষের চাপ যে পা ফেলার জায়গা নেই।

আন্তর্জাতিক আহ্বান

গাজায় স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসার সরঞ্জাম আনা–নেওয়ার জন্য নিরাপদ পথ তৈরি করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ডব্লিউএইচওর মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, চলমান এই সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পাশাপাশি যেসব মানুষের ওষুধসহ জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন, তাঁদের জন্য একটি ‘মানবিক করিডর’ তৈরি করে দেওয়া হোক।

ইসরায়েল থেকে গাজায় পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ওষুধসামগ্রীসহ জরুরি সব পণ্য সরবারহ বন্ধের বিষয়টি উল্লেখ করে জাসারেভিচ বলেন, ‘জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ছাড়া হাসপাতালগুলো চালানো সম্ভব নয়।’

গাজায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। সংস্থাটির ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক উইলি বেরগোনি বলেন, একটি গোষ্ঠীর জন্য পুরো একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া শাস্তির পর্যায়ে পড়ে। এটা করা উচিত হবে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ও ইউরোপীয় কমিশন ফিলিস্তিনে সহায়তা বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে উল্লেখ করে তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন উইলি বেরগোনি। সহায়তা বন্ধ না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ত্রাণসহায়তা অত্যন্ত জরুরি।