ইরানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি। সোমবার সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন তিনি
ইরানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি। সোমবার সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন তিনি

ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার শিকার কে এই ইরানি জেনারেল জাহেদি

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি সিরিয়ায় ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন।

গত সোমবার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। এই হামলায় জাহেদি ছাড়াও ছয়জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইরানের আরেক জেনারেল আছেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, কূটনৈতিক মিশনে দিবালোকের এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে ‘অনুশোচনা’ করিয়ে ছাড়বে তেহরান।

সামরিক জীবন

জাহেদি ১৯৬০ সালের ২ নভেম্বর ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইসফাহানে জন্ম নেন।

ইরানের ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের দুই বছর পর আইআরজিসিতে যোগ দেন জাহেদি। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর।

জাহেদি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরের বছর ১৯৮০ সালে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন প্রতিবেশী দেশ ইরাক। আট বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলে।

জাহেদি ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি আইআরজিসির স্থল বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। এই ব্রিগেড একাধিক বড় অভিযানে অংশ নেয়।

তারপর জাহেদিকে ইরানের ১৪তম ইমাম হোসেন ডিভিশনের কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় সংগঠিত ইরানি স্থল বাহিনীর আরেকটি প্রধান অংশ ছিল এই ডিভিশন।

ডিভিশনটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশ নিয়েছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পরও ১৯৯১ সাল নাগাদ এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন জাহেদি।

ইরানের সামরিক পদে জাহেদির আরও ওপরে ওঠার পরবর্তী রেকর্ডটি আসে ২০০৫ সালে। তখন তিনি অল্প সময়ের জন্য রেভল্যুশনারি গার্ডের বিমানবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।

একই বছর জাহেদিকে আইআরজিসির স্থল বাহিনীর কমান্ড দেওয়া হয়। এই পদে তিনি তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন।

সেই সময়ে জাহেদি এক বছর থার-আল্লাহ সদর দপ্তরের নেতৃত্ব দেন, যার দায়িত্ব প্রধানত রাজধানী তেহরানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অভিযান-সংক্রান্ত আইআরজিসির উপপ্রধান হিসেবেও কাজ করেন জাহেদি।

আঞ্চলিক প্রভাবের মুখ

অন্তত ২০০৮ সাল থেকে জাহেদি পুরো অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বিস্তারের কাজে ব্যাপকভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি আইআরজিসির অভিজাত কুদস ফোর্সের বিদেশ শাখায় কমান্ডার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।

জাহেদি সিরিয়া ও লেবাননে কুদস ফোর্সের নানা কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে কয়েক দশক ধরে এই দুই দেশে ইরানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক প্রভাব বাড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে জাহেদি ছিলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের প্রতি ইরানের সাহায্য-সমর্থন জোগানের শীর্ষ ব্যক্তিদের একজন। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের ফলে এখন বাশার আল-আসাদ একটি খণ্ডিত দেশের ক্ষমতায় আছেন।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছিলেন কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। এ ঘটনার পর জাহেদি হলেন ইরানের সর্বোচ্চ পদধারী কোনো সামরিক কমান্ডার, যিনি বিদেশি হামলায় নিহত হলেন।

সোলেইমানি অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর কথিত ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ প্রধান কারিগর ছিলেন। তিনি ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনের গোষ্ঠীগুলোকে রাজনৈতিক-সামরিক সমর্থন দেওয়াসহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ফিলিস্তিনিদের সহায়তায় কয়েক দশক ধরে কাজ করেছেন।

সিরিয়ায় ইরানের কমান্ডারদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলের বিমান হামলা নতুন কিছু নয়। সবশেষ এমন হামলা হলো গত সোমবার।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে সিরিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার সাইয়্যেদ রাজি মুসাভি নিহত হন।

ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের নিশানা

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানি স্বার্থের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে জাহেদির ওপর ইসরায়েলি গোয়েন্দারা বছরের পর বছর ধরে নজর রাখছিলেন।

বেশ কয়েকবার ইসরায়েলি গণমাধ্যমে জাহেদির নাম আসে। তাঁর ছবি প্রকাশ করা হয়। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে জাহেদির পরিচয় দেওয়া হয়, আইআরজিসির কুদস ফোর্সের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে, যাঁকে ধরতে চায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলের এই তালিকায় সাইদ ইজাদির নামও আছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইরানের যোগাযোগকারী শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা তিনি। গত সোমবারের হামলার পর প্রাথমিকভাবে গুজব ছড়িয়েছিল, তিনিও নিহত হয়েছেন। পরে অবশ্য এই গুজব নাকচ করা হয়।

জাহেদির ডেপুটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি রহিমিও গত সোমবার ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন।

জাহেদি নিহত হওয়ার পর ইরানি গণমাধ্যম তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবি প্রকাশ করেছে। ছবিতে তাঁকে অঞ্চলটির ইরান-সংশ্লিষ্ট শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা গেছে।

সময়-তারিখ নেই—এমন কয়েক দশকের পুরোনো একটি ছবিতে জাহেদিকে সোলেইমানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ছবিতে লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ আছেন। আছেন ইসরায়েলি গুপ্তহত্যার শিকার হিজবুল্লাহর সাবেক সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ইমাদ মুগনিয়াহসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি।

আরেকটি ছবি দেখা যায়, যেটি গত শতকের আশির দশকের (১৯৮০-৮৮) ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ের বলে ধারণা করা হয়। ছবিটি বলছে, খামেনির ঘনিষ্ঠ ছিলেন জাহেদি।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন গতকাল মঙ্গলবার জাহেদির বাড়ির একটি জমায়েত দেখায়। সেখানকার একটি ছবিতে হাসান তেহরানি মোগাদ্দামের পাশে দেখা যায় জাহেদিকে। মোগাদ্দাম ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি ২০২২ সালের নভেম্বরে তেহরানের কাছে এক রহস্যময় বিস্ফোরণে নিহত হন। এই ঘটনার জন্য অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে দায়ী করেনি ইরান।

জাহেদির ছেলে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেছেন, তাঁর বাবার শাহাদাতবরণের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা অবশেষ পূর্ণ হয়েছে। তিনি শুধু বলবেন, আল্লাহ তাঁর বাবাকে পুরস্কৃত করেছেন।