ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ইসরায়েলে হামলা এবং গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা হামলা নিয়ে এখন ব্যস্ত পুরো বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এই লড়াইয়ে ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজরও এখন এই সংকটের দিকে। এতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকট থেকে রাশিয়া কী কী সুবিধা পেতে পারে, তা লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বিবিসির রাশিয়া এডিটর স্টিভ রোজেনবার্গ। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনটা কল্পনা করাই যায় যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি পাহাড়ি আস্তানায় বসে আছেন বিপুল ক্ষমতার আধার হিসেবে থাকা একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সামনে, আর বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
তিনি একটি বোতাম টিপছেন আর বলকান অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। তিনি আরেকটি বোতাম টিপছেন এবং মধ্যপ্রাচ্য বিস্ফোরিত হচ্ছে। এমনটা কল্পনা করা যায়... তবে সম্ভবত সত্য নয়। এটা বৈশ্বিক পর্যায়ে রুশ প্রেসিডেন্টের প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরে।
হ্যাঁ, রাশিয়ার সম্পর্ক রয়েছে হামাসের সঙ্গে এবং দেশটি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, বর্তমানে মস্কো ও তেহরানের পূর্ণ মাত্রায় প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব রয়েছে। তবে এতে এটা বোঝায় না যে, ইসরায়েলে হামাসের হামলায় মস্কোর সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে বা তারা এ বিষয়ে আগেই জানত।
চলতি সপ্তাহে মস্কোয় ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার বেন জ্বি রুশ পত্রিকা কোমারসেন্তকে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি না যে, রাশিয়া কোনোভাবে সম্পৃক্ত।’ ইসরায়েলে হামাস যে নৃশংসতা চালিয়েছে তাতে রাশিয়ার সম্পৃক্ততার কথা বলাটা ‘সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতা’।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেমস মার্টিন সেন্টার ফর নন-প্রোলিফারেশন স্টাডিজের রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হান্না নোট্টে বলেছেন, ‘রাশিয়া সরাসরি হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে বা হামাস সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে, এমন কিছুর প্রমাণ আমি দেখছি না। তবে এটা সত্য যে, হামাসের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়া কখনো হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেনি। হামাসের প্রতিনিধিরা গত বছর ও এ বছর মস্কো সফর করেছেন।’
বার্লিনভিত্তিক এই গবেষক আরও বলেন, ‘তবে এ থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না যে, তাদের মধ্যে বিরাট সামরিক সহায়তার বিষয় রয়েছে। এমনকি যদিও রাশিয়ার তৈরি সামরিক ব্যবস্থা গাজা উপত্যকায় পৌঁছেছে। সম্ভবত তা ঘটেছে ইরানের সহযোগিতায় সিনাই উপদ্বীপ (মিশরের) হয়ে।’
বিষয়টি এভাবেও বলা যায় যে, প্রেসিডেন্ট পুতিন বোতামে টিপ দিয়ে ‘মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ’ শুরু করেননি।
কিন্তু তিনি এখন এর সুফল ঘরে তোলার জন্য প্রস্তুত?
অবশ্যই। কীভাবে সেটা সম্ভব, তা তুলে ধরা হল:
মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রধান খবর হয়ে উঠেছে তা। খবরের শিরোনাম কতটা রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ইসরায়েলের দিকে সরে গেছে, সেই হিসাব এখন কষছে মস্কো।
কিন্তু এখানে শুধু খবরের বিষয় বদলে যাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু রয়েছে। রাশিয়ার কর্তাব্যক্তিরা এটাও আশা করছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির কারণে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহের একটা বড় অংশ এখন ইউক্রেনের বদলে ইসরায়েলের দিকে ঘুরে যাবে।
রুশ কূটনীতিক কনস্টানটিন গাবরিলোভ ক্রেমলিনপন্থী একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই সংকট সরাসরি (ইউক্রেনে) বিশেষ সামরিক অভিযানের গতিপ্রকৃতির ওপর প্রভাব ফেলবে। ইসরায়েলে সংঘাতের কারণে ইউক্রেনের অস্ত্র–অর্থদাতারা ভিন্ন দিকে যাবেন। এটার অর্থ এই নয় যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনের বাসিন্দাদের ত্যাগ করবেন। তবে সেখানে সামরিক সহায়তার পরিমাণ কমে যাবে... এবং এই অভিযানের গতিপ্রকৃতি উল্লেখযোগ্যভাবে রাশিয়ার পক্ষে যেতে পারে।’
এটা রাশিয়ার পক্ষে যাওয়ার চিন্তা? কিন্তু তা খুবই সম্ভব।
শুক্রবার ইসরায়েলে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওড অস্টিন বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের পাশে থাকব এবং আমরা সেটা পারি। এমনকি ইউক্রেনের পাশে থেকেও।’
তবে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে তাতে একইসঙ্গে দুটি ভিন্ন যুদ্ধে দুই মিত্রকে সহায়তার ক্ষেত্রে আমেরিকার সক্ষমতা পরীক্ষায় পড়বে।
প্রকৃতঅর্থে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে ওই অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে রাশিয়া।
এই অঞ্চলের সংকট সমাধানে অতীতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় যুক্ত থেকে এই ভূমিকা তারা অনেক আগে থেকেই রেখে এসেছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘রাশিয়া (এই সংকটের) সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে এবং সেটা করবে। আমরা এই সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’
চলতি সপ্তাহে মস্কো সফরে গিয়ে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি ওই অঞ্চলে প্রকৃতঅর্থে যুদ্ধবিরতির একটি উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
শান্তিপ্রতিষ্ঠার ভূমিকায় রাশিয়া? এটা একটি কঠিন বিষয়।
সর্বপরি, এটা সেই দেশ যারা প্রতিবেশী দেশে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ চালিয়েছে। ২০ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং এতে এত বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে যে, তা বিশ্ববাসীর কাছে বড় ধাক্কা হিসেবে এসেছে।
তাছাড়া ‘আমরা পারি এবং ভূমিকা রাখব’ বলার অর্থ এটা নয় যে, এই সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো আপনাকে শান্তিপ্রতিষ্ঠার একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দীর্ঘ দিনের স্বার্থ রয়েছে। সেটা শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন আরবদের সমর্থনে অবস্থান নেওয়ার মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলায় ওই অবস্থান নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় মদদে ইহুদিবিদ্বেষ সোভিয়েত আমলের অংশ হয়ে উঠেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। এর একটা বড় কারণ ছিল সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলো থেকে ১০ লাখের বেশি ইহুদির ইসরায়েলে পাড়ি জমানো।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া ইসরায়েলের শত্রু দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশেষত ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাশিয়া–ইসরায়েল সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
রাশিয়ার গোয়েন্দাদের কাছে এখন একটি বড় সুযোগ এসেছে, যা তারা আগেও বহু বার করেছে, সেটা হলো আমেরিকাকে দোষারোপ করা।
ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ভ্লাদিমির পুতিন সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কথাটি বলতে চেয়েছেন তা হল, এটা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যর্থতার একটি উদাহরণ।
মস্কো সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে যেভাবে আক্রমণ করে আসছে, এটা তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের জন্য আমেরিকাই মূলত দায়ী, এমন একটি চিত্র দিতে পারাটা ওই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের প্রভাব কমিয়ে রাশিয়ার অবস্থান শক্ত করার কৌশল।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত থেকে রাশিয়ার সুবিধা পাওয়ার আলোচনায় বিপদের দিকটিও উঠে এসেছে।
রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হান্না নোট্টে বলেন, ‘এই সংকট যদি ইউক্রেন থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়– যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসরায়েলের ভূমিকা বিবেচনায় তেমনটি হওয়ার বাস্তব ঝুঁকিও রয়েছে– হ্যাঁ, সেক্ষেত্রে রাশিয়া স্বল্পমেয়াদে সুবিধা পেতে পারে।’
তবে এই যুদ্ধ যদি বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে, হামাসকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দেওয়া ইরানসহ অন্যরাও যদি জড়িয়ে যায় তাহলে রাশিয়া সুবিধা পাবে না বলে মনে করেন হান্না নোট্টে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ চায় না। যদি ঘটনা সেদিকে মোড় নেয় এবং এটা স্পষ্ট হয় যে আমেরিকা জোরালোভাবে ইসরায়েলের পক্ষ নিচ্ছে তাহলে আমি মনে করি, ইরানের পক্ষ নেওয়া ছাড়া রাশিয়ার আর কোনো উপায় থাকবে না। আমি নিশ্চিত নই, তারা সেটা চায় কি না।
‘আমি মনে করি, পুতিন এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। আমি মনে করি না যে, রাশিয়ার কূটনীতি এমন একটি জায়গায় যাক যেখানে তাদের একটি পক্ষ বেছে নিতে হয়। তবে এই সংঘাত যত বাড়বে, তারাও তত বেশি চাপ অনুভব করতে পারে।’