গাজায় ইসরায়েলি হামলা

হাসপাতালে মানবিক বিপর্যয়

জ্বালানিসংকটে গাজার প্রধান দুটি হাসপাতালও বন্ধ হয়ে গেছে। হামলায় আল-শিফা হাসপাতালের কার্ডিয়াক ওয়ার্ড ধ্বংস হয়েছে।

ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ভবন। নিহতদের খোঁজে স্বজনেরা। গতকাল গাজার খান ইউনিসে
রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজার হাসপাতালগুলো ঘিরে বড় ধরনের অভিযান অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানকার প্রধান দুটি হাসপাতালও বন্ধ হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়ের। বিদ্যুৎ না থাকায় আল-শিফা হাসপাতালে অপরিণত দুই নবজাতকসহ পাঁচ রোগী মারা গেছেন। এদিকে গত ৩৭ দিনে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১১ হাজার ১০০ ছাড়িয়ে গেছে।

হামলা ও জ্বালানিসংকটের কারণে গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম হাসপাতাল আল-কুদসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে বলে গতকাল রোববার জানিয়েছে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট। একই কারণে আগের দিন সেখানকার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

গত ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর গাজায় জ্বালানি ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এরই মধ্যে কয়েক দিন ধরে গাজা নগরীর হাসপাতালগুলো ঘিরে অবস্থান নেয় ইসরায়েলি ট্যাংক। হাসপাতালগুলোয় দফায় দফায় হামলা চালানো হচ্ছে।

জ্বালানিসংকটের কারণে আল-কুদস হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অভাবে এখন প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

গাজার হাসপাতালগুলোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাকোত বলেছেন, সেখানকার হাসপাতালগুলোয় এক ফোঁটা জ্বালানিও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, আল-শিফা হাসপাতাল নিরাপদ নয়। সেখানে মরদেহের কাছে পর্যন্ত যাওয়া যাচ্ছে না।

এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোগী ছাড়াও আল-শিফা হাসপাতালে দেড় হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। খাবার ও পানির অভাবের পাশাপাশি ইসরায়েলি হামলার কারণে তাঁরা মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। হামাস সরকারের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী ইউসেফ আবু আল-রিশ বলেন, ইসরায়েলের বিমান হামলায় আল-শিফা হাসপাতালের কার্ডিয়াক ওয়ার্ড ধ্বংস হয়ে গেছে। হামলায় দোতলা ভবনটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

মরদেহের কাছে যাওয়া যাচ্ছে না

জ্বালানিসংকট; বিদ্যুৎ না থাকা; চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাবার ও পানির অভাবে গাজার হাসপাতালগুলোয় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন সেখানকার লোকজন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আল-শিফা হাসপাতালে পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অপরিণত দুই নবজাতকও রয়েছে। এই হাসপাতালে শতাধিক মরদেহ পড়ে আছে। হামলার কারণে এসব মরদেহ দাফন করার মতো পরিস্থিতি নেই।

দুই দিন আগে আল-শিফা হাসপাতাল চত্বরে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ১৩ জন নিহত হন। গতকাল সেখান থেকে নারী-শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের একটি দল বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে গুলি চালান ইসরায়েলি সেনারা।

গাজায় ‘শিশুদের বাঁচতে দাও’-প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভরত বসনিয়ান এক শিশু। গতকাল দেশটির রাজধানী সারায়েভোতে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচএ) বলেছে, আল-শিফা হাসপাতালের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেখানকার কোনো খোঁজখবর তারা পাচ্ছে না। স্বাস্থ্যকর্মী, লাইফ সাপোর্টে থাকা শিশুরাসহ শত শত অসুস্থ ও আহত রোগী এবং হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

গাজার ইন্দোনেশিয়া হাসপাতালের মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। জ্বালানিসংকট ও ইসরায়েলি হামলার কারণে গাজার ৩৬টি হাসপাতালের ২০টি বন্ধ হয়ে গেছে। জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা এ তথ্য দিয়েছে। অবশ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া হাসপাতালের সংখ্যা ২১টি বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট।

গাজায় জাতিসংঘ ভবনে হামলা

গত শনিবার রাতে গাজায় জাতিসংঘের ভবনেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে সেখানে আশ্রয় নেওয়া বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা আচিম স্টেইনার।

অন্যদিকে উত্তর গাজার বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতে বলে সেখানে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল ভোররাতে খান ইউনিসে একটি আবাসিক ভবনে চালানো হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গাজার মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণের রাফাহ এলাকায়ও হামলা হয়েছে।

গতকাল এক বিবৃতিতে গাজার তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১১ হাজার ১০০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আট হাজারের বেশি নারী ও শিশু রয়েছে। আহত হয়েছেন ২৮ হাজারের বেশি।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারির দাবি

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আহ্বান জানিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পান্দোর। দেশটির সানডে টাইমস পত্রিকায় লেখা এক অভিমতে তিনি এ কথা বলেন।

পান্দোর লিখেছেন, ‘আমরা আইসিসির এখতিয়ারের অধীনে চারটি অপরাধের তিনটি—যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার তদন্তে গতি বাড়াতে এবং সেগুলো উদ্‌ঘাটনে আইসিসির প্রসিকিউটরের প্রতি আহ্বান জানাই।’

দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইসিসির সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়) নীতির আওতায় সবচেয়ে বেশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’ এসব ব্যক্তির মধ্যে নেতানিয়াহু ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা থাকতে পারেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।