লেবাননে ব্যাংকে ‘ডাকাতির’ ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলা এক প্রবণতায় রূপ নিচ্ছে। কিন্তু অস্ত্রধারী এই ‘ডাকাতেরা’ ব্যাংকে ঢুকছেন অন্যের অর্থ লুট করতে নয়। তাঁরা শুধুই চাচ্ছেন, ব্যাংকে নিজেদের জমানো অর্থ তুলতে।
অবাক করার বিষয় হলো, এমন ডাকাতিতে যুক্ত ব্যক্তিদের আটক ও বিচারের আওতায় আনার বদলে অবাধে বিচরণ করতে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের তুলে ধরা হচ্ছে রীতিমতো নায়ক হিসেবে। আর এসবই হচ্ছে দেশটিতে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে।
লেবাননে অর্থনৈতিক সংকট যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাও তত বাড়ছে। দেশটির কালোবাজারে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা লেবানিজ পাউন্ডের অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৯০ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে জনগণ নিজেদের ব্যাংক হিসাব থেকে কী পরিমাণ অর্থ তুলতে পারবেন, সেটি বেঁধে দিয়েছে সরকার। দেশটির সরকারের এ পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও সংকটজনক করে তুলেছে।
২০১৯ সাল থেকে লেবাননে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মন্দার শুরু। অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশকেই (আনুমানিক ৩০ লাখ) দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। এ তথ্য জাতিসংঘের। অর্থনৈতিক দৈন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশটিতে দিনে দিনে বেড়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। স্বাভাবিকভাবে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কমেছে।
অর্থনীতিতে মন্দা শুরুর পরপরই, অর্থাৎ ২০১৯ সাল থেকে লেবানন সরকার মানুষের সঞ্চয়ের ওপর ধাপে ধাপে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। কার্যত, এতে লাখ লাখ গ্রাহক তাঁদের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের সুযোগ হারান।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে অর্থসহায়তা না পেলে সংকট মোকাবিলা করা কার্যত সম্ভব হবে না। তবে অর্থসহায়তা দেওয়ার আগে অর্থনীতিতে নানা সংস্কারের শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ—আমিন সালাম, লেবাননের অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী।
জেইনা খোদর একটি ব্যাংকের গ্রাহক। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আপনি যখনই অর্থ তুলতে যাবেন, তখন আপনাকে বাজারমূল্যের চেয়ে কম দেওয়া হবে।’ উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ধরুন, আপনি ৭০০ ডলার তুলবেন। কিন্তু তারা (ব্যাংক) আপনাকে ৭০০ ডলার হিসাবে ২০০ ডলার ধরিয়ে দেবে। অর্থের এ এক বড় দরপতন।’
লেবাননে চলতি বছর ডাকাতি করে ব্যাংক থেকে নিজের অর্থ তুলে নেওয়ার প্রথম ঘটনা জানা যায় গত জানুয়ারিতে। নিজের অ্যাকাউন্টে (হিসাব) জমানো বৈদেশিক মুদ্রা তুলতে না পেরে এক ব্যক্তি অস্ত্র নিয়ে দেশটির পূর্বাঞ্চলের একটি ব্যাংকে ঢুকে এক ডজন ব্যক্তিকে জিম্মি করেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, এ ঘটনার পর ওই ব্যক্তিকে তাঁর জমানো অর্থ থেকে কিছু দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হয়।
লেবাননে অর্থনৈতিক সংকট যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাও তত বাড়ছে। দেশটির কালোবাজারে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা লেবানিজ পাউন্ডের অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৯০ শতাংশের বেশি।
এদিকে গত মাসে এক সশস্ত্র ব্যক্তি রাজধানী বৈরুতের একটি ব্যাংকে ঢুকে কর্মী ও গ্রাহকদের জিম্মি করেন। এর আগে তাঁকে ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, বাবার চিকিৎসার জন্য তিনি নিজের হিসাব থেকে যে দুই লাখ ডলার তুলতে চাচ্ছেন, সেটি দেওয়া সম্ভব নয়। মজার বিষয় হলো, এই ডাকাতির ঘটনা যখন ঘটছিল, তখন ওই ব্যাংকের বাইরে সমবেত হওয়া লোকজন ডাকাতিতে যুক্ত ব্যক্তির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে হর্ষধ্বনি দিচ্ছিলেন।
সর্বশেষ গত বুধবার সশস্ত্র আরেক ব্যক্তি লেবাননের পার্বত্য শহর অ্যালের ব্যাংকমেডের একটি শাখায় ঢুকে তাঁর জমানো টাকা ওঠানোর চেষ্টা চালান। একই দিন সালি হাফিজ নামের এক নারী বৈরুতের বিএলওএম ব্যাংকের শাখায় একটি বন্দুক নিয়ে ঢোকেন। সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন। ক্যানসারে আক্রান্ত বোনের চিকিৎসা খরচ জোগাতে নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ তুলতে এ কাণ্ড ঘটান তিনি।
সালি হাফিজ অবশ্য পরে বলেন, তিনি খেলনা বন্দুক নিয়ে ওই ব্যাংকে ঢুকেছিলেন। ব্যাংকে ঢুকে তিনি প্রথমে পেট্রল ছিটিয়ে দেন। জমানো টাকা দিতে না পারলে ব্যাংকে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। পরে জমানো ২০ হাজার ডলার থেকে ১৩ হাজার ডলার তুলতে সক্ষম হন সালি।
সালি হাফিজ ও অ্যালে শহরের ব্যাংকে হানা দেওয়া ব্যক্তি ‘ডিপোজিটরস আউটক্রাই’ নামের একটি গ্রুপের সদস্য বলে জানা গেছে। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আলা খরচিদ। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, এভাবে ব্যাংকে হানা দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় মানুষের হাতে নেই। বর্তমান মরিয়া পরিস্থিতিই তাঁদের এ কাজে বাধ্য করেছে।
সংকট মোকাবিলায় লেবাননে দ্রুত অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি, এমনটাই মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বারবার দেশটির সরকারকে অর্থনৈতিক সংস্কারে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষত সরকারি-বেসরকারি অপব্যয় কমিয়ে আনা, সীমাহীন দুর্নীতির লাগাম টানা ও অকার্যকর জ্বালানি খাত ঢেলে সাজানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
খরচিদ আরও বলেন, এই লোকেরা দশকের পর দশক কাজ করেছেন। তাঁরা শাসকদের প্রাসাদ নির্মাণের জন্য কাজ করেননি। কিন্তু এখন তাঁরা এক বোতল ওষুধ কিনতে পারছেন না। শাসকদের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, এটি কোনো সরকার হতে পারে না। তাদের নেই কোনো অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা। দেশে এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সামান্যই আছে।
অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর থেকে লেবাননের আর্থিক খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে ৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ হিসাব দেশটির সরকারের। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, লেবাননের অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। এ পরিস্থিতি ১৯ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ্বে দেখা দেওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ তিনটি সংকটের একটি হতে পারে।
গত এপ্রিলে লেবাননের উপপ্রধানমন্ত্রী সাদেহ আল-সামি দেশটির আল-জাদিদ টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এতে সংকটজনক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। সঙ্গে রাষ্ট্র হিসেবে লেবাননও দেউলিয়া হয়ে গেছে। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছে। এখন কীভাবে জনগণের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়, আমরা সে চেষ্টাই করব।’
সংকট মোকাবিলায় লেবাননে দ্রুত অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি, এমনটাই মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বারবার দেশটির সরকারকে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষত সরকারি-বেসরকারি অপব্যয় কমিয়ে আনা, সীমাহীন দুর্নীতির লাগাম টানা এবং দেশটির অকার্যকর জ্বালানি খাত ঢেলে সাজানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এমনকি লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে নিরীক্ষা চালানোর আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন।
তবে বিদেশি সহায়তা ছাড়া চলমান সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছে লেবানন সরকার। এ বিষয়ে দেশটির অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী আমিন সালাম বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে অর্থসহায়তা না পেলে সংকট মোকাবিলা করাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। তবে সহায়তা দেওয়ার আগে অর্থনীতিতে নানা সংস্কারের শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ।
এত কিছুর পরও লেবাননের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত একটি কার্যকর সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তাই দিন দিন দেশটির অর্থনীতি আরও ভঙ্গুর হচ্ছে। সংকটও জোরালো হচ্ছে জনজীবনে। অথচ সংকট থেকে মুক্তির পূর্বশর্ত বিবেচিত হচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কার। তাই যত দ্রুত সংস্কার হবে, তত দ্রুত লেবানন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
ভাষান্তর: মো. আবু হুরাইরাহ্ ও অনিন্দ্য সাইমুম ইমন