‘দাহিয়া ডকট্রিনের’ প্রবর্তক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তৎকালীন নর্দান কমান্ডের প্রধান জেনারেল গাদি আইজেনকট। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি ২০১৯ সালে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ হয়েছিলেন।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজার বড় অংশই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেখানকার বড় অংশই এখন বসবাসের অনুপযোগী। গত মে মাসে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) থেকে দেওয়া এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, যুদ্ধে গাজার ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ সরাতেই ১৫ বছর তথা ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। বেসামরিক স্থাপনায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ নতুন কিছু নয়। বরং নিজেদের যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবেই ইহুদি রাষ্ট্রটি এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে থাকে। তাদের এই যুদ্ধনীতি ‘দাহিয়া (দাহিয়েহ) ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত।
এই যুদ্ধনীতি ইসরায়েল প্রথম গাজায় প্রয়োগ করেনি। এই যুদ্ধনীতি প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছিল লেবাননে। অক্টোবরের শুরু থেকে সেই লেবাননে আবার কুখ্যাত এই যুদ্ধনীতি প্রয়োগ শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইতিমধ্যে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশটির রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরায়েল। সেখানকার বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছে।
‘দাহিয়া ডকট্রিন’ কী
ইনস্টিটিউট অব মিডল ইস্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের (আইএমইইউ) মতে, দাহিয়া ডকট্রিন হলো ব্যাপক ও অসম শক্তি প্রয়োগ এবং বেসামরিক লোকজন ও স্থাপনার ওপর ইচ্ছাকৃত হামলার ইসরায়েলি রণনীতি।
চলমান যুদ্ধে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে ইউএনডিপির আরব দেশগুলোর আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক আবদুল্লাহ আল-দারদারি বলেন, ‘আমরা ১৯৪৫ সালের পর এ রকমটা আর দেখিনি। গত প্রায় ৪০ বছরে গাজায় মানব উন্নয়নের জন্য যত বিনিয়োগ করা হয়েছিল, তার সবই জলে ভেসে গেছে...আমরা বলতে গেলে ১৯৮০-এর দশকে ফিরে গেছি।’
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শাখার (আঙ্কটাড) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলের ব্যাপক সেনা অভিযানে গাজায় নজিরবিহীন মানবিক, পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। উপত্যকাটির অর্থনীতি প্রাক্-উন্নয়ন অবস্থা থেকে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার পর যদি গাজা ২০০৭-২০২২ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারায় চলতে শুরু করে, সে ক্ষেত্রেও ২০২২ সালপূর্ব (যুদ্ধপূর্ব) জিডিপি পুনরুদ্ধার করতে উপত্যকাটির বাসিন্দাদের লাগবে ৩৫০ বছর।
বিশ্লেষকদের মতে, মূলত কোনো সরকার বা গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে সেখানকার জনগণকে বাধ্য করতেই যুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের এই ‘দাহিয়া ডকট্রিন‘ প্রয়োগ করে থাকে ইসরায়েল। যদিও এই নীতি প্রয়োগ করে তাদের উদ্দেশ্য কতটা অর্জিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
যেভাবে ‘দাহিয়া ডকট্রিনের’ উৎপত্তি
দাহিয়া শব্দটি এসেছে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের দাহিয়া এলাকার নাম থেকে। এলাকাটি দাহিয়েহ নামেও পরিচিত। দাহিয়াতে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সদর দপ্তর। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ২০০৬ সালের যুদ্ধে দাহিয়াকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। সেখানকার এক হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে, যাদের এক-তৃতীয়াংশই ছিল নারী ও শিশু। ওই যুদ্ধে বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানিশোধন কেন্দ্র, সেতু, বন্দর অবকাঠামোসহ লেবাননের বেসামরিক স্থাপনায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল ইসরায়েল।
‘দাহিয়া ডকট্রিনের’ প্রবর্তক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তৎকালীন নর্দান কমান্ডের প্রধান জেনারেল গাদি আইজেনকট। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি ২০১৯ সালে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ হয়েছিলেন।
ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ যুদ্ধ কেমন হবে, তার ধারণা দিতে গিয়ে ২০০৮ সালে আইজেনকট বলেছিলেন, ‘যেসব গ্রাম থেকে ইসরায়েলে হামলা হবে, বৈরুতের দাহিয়া এলাকায় ২০০৬ সালে যা ঘটেছিল, সেগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হবে। আমরা এসব গ্রামে অসম শক্তি প্রয়োগ করব এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাব। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব গ্রাম বেসামরিক নয়, এগুলো সামরিক ঘাঁটি। এটি কোনো সুপারিশ নয়; এটি পরিকল্পনা। আর দাপ্তরিকভাবে ইতিমধ্যে এ পরিকল্পনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’
আইজেনকটের এ কথার সত্যতা মেলে পরবর্তী সময়ে গাজার হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনী মধ্যে চলা সংঘাতেও। ২০০৮ সালের শেষ এবং ২০০৯ সালের শুরুতে গাজায় এ নীতি প্রয়োগ করেছিল ইসরায়েল। ওই সময় ইসরায়েলের হামলায় ১ হাজার ৪০০ জনের মতো ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই যুদ্ধে বেসামরিক লোকজনকে শাস্তি দেওয়া, হেনস্তা করা এবং ভয় দেখানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে অসম শক্তি প্রয়োগ করেছিল ইসরায়েল। ওই হামলার মধ্য দিয়ে গাজার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল এবং স্থায়ীভাবে সেখানকার বাসিন্দাদের পরনির্ভর করে দেওয়া হয়েছিল।
ইসরায়েল ২০১৪ সালের হামলার সময়ও গাজায় একই নীতি প্রয়োগ করেছিল। ওই যুদ্ধে প্রায় পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী, যাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। ওই যুদ্ধের সময় গাজার প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্রে ধ্বংস করে দিয়েছিল ইসরায়েল। গাজার অর্ধেক বাসিন্দা পানিসংকটে পড়েছিল। হাজার হাজার মানুষ বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাস্তায় উপচে পড়েছিল পয়োনালার বর্জ্য।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরুর পরও একই নীতি নিয়েছে ইসরায়েল। এবার অনেকটা ‘পোড়ামাটি নীতি’ নিয়েছে দেশটি। প্রায় পুরো গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের প্রায় ৭০ ভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলে হামলায় আহত হয়েছেন এক লাখের বেশি ফিলিস্তিনি, যাঁদের অনেকেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন।
সর্বশেষ ১ অক্টোবর থেকে লেবাননে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এবারও হিজবুল্লাহ অধ্যুষিত সেই দাহিয়া এলাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল। একই পরিণতির মুখে পড়েছে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলও। ইতিমধ্যে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। হিজবুল্লাহর প্রশাসনিক দপ্তরের পাশাপাশি ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অনেকটা ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ আরও একবার দাহিয়া তথা লেবাননে প্রয়োগ করছে ইসরায়েল।
কেন ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ প্রয়োগ করে ইসরায়েল
বেশ কয়েকটি কারণে যুদ্ধে ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ প্রয়োগ করে আসছে ইসরায়েল। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোনো সরকার বা গোষ্ঠীকে পরাস্ত করতে পুরো জনগোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়া। পুরো জনগোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য, যাতে তারা ওই সরকার বা গোষ্ঠীকে সমর্থন না দেয় এবং তাদের সদস্যদের আশ্রয় দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বেসামরিক স্থাপনায় হামলার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো বিরোধী পক্ষকে সার্বিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া বা পরনির্ভরশীল করে দেওয়া। যুদ্ধ শেষে এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে সামরিক কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনীয় জোর দিতে পারে না প্রতিপক্ষ। বিশেষ করে এসব খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে গিয়ে সামরিক খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা শত্রুপক্ষের সেভাবে আর সম্ভব হয় ওঠে না। ফলে নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত শত্রুপক্ষ হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে না।
সর্বোপরি, একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখতে ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ প্রয়োগ করছে ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি বিরোধী পক্ষকে সংঘাত থেকে নিবৃত্ত রাখতে শক্তির ভারসাম্য দুভাবে কাজ করে। যদি দুটি পক্ষ সমশক্তির হয় অথবা একেবারে অসম শক্তির হয়। সমশক্তির হলে পারস্পরিক ক্ষতি বিবেচনায় সংঘাত এড়িয়ে চলে দুই পক্ষ। আবার অসম শক্তির কারণে একেবারে দুর্বল প্রতিপক্ষ নিজের ক্ষতির কথা ভেবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে চায় না। ইসরায়েল দ্বিতীয় নীতিটি মেনে চলে। দেশটি প্রতিপক্ষকে একেবারে দুর্বল রেখে একচেটিয়া আধিপত্যের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।
তথ্য সূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট