ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরি
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরি

হামাস নেতা সালেহকে হত্যার পরিণতি কী হতে পারে

কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, বিদেশে থাকা হামাস নেতাদের হত্যা করা হবে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েল-ঘোষিত এই গুপ্তহত্যা মিশনের প্রথম শিকার হলেন সালেহ আল-আরৌরি।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রতিবেশী দেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হন হামাসের উপপ্রধান সালেহ।

গুপ্তহত্যার জন্য সালেহকে ইসরায়েল সতর্কতার সঙ্গেই বেছে নিয়েছে। কারণ, তিনি হামাসের অন্যতম জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা। এ ছাড়া ইরান ও লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে হামাসের যোগসূত্র রক্ষার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরেও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন সালেহ। তাঁর জন্ম পশ্চিম তীরে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পশ্চিম তীরে সহিংসতা বেড়েছে।

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছিল হামাস। হামাসের এই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বেসামরিক লোকজন। একই সঙ্গে প্রায় ২৪০ জনকে ইসরায়েল থেকে ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় নিয়ে জিম্মি করে হামাস।

কিছু ইসরায়েলি কর্মকর্তার ধারণা, ৫৭ বছর বয়সী সালেহ ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরিকল্পনার কথা আগে থেকেই জানতেন।

গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পশ্চিম তীরের হেবরন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে সালেহ ইসলামি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসলামপন্থী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল।

প্রথম ইন্তিফাদার জেরে ১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার পরই হামাসে যোগ দেন সালেহ। তিনি হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডস গঠনে সহায়তা করেছিলেন।

১৯৯২ সালে সালেহকে জেলে পোরে ইসরায়েল। পরবর্তী ১৮ বছরের প্রায় পুরো সময়ই তিনি ইসরায়েলি কারাগারে কাটান।

একজন অপহৃত ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দীকে ২০১০ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত সমঝোতা আলোচনায় সহায়তা করেছিলেন সালেহ।

প্রথমে সিরিয়ায় অবস্থান করে হামাসের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন সালেহ। পরে কাতার যান। সবশেষ তিনি লেবাননে বসে সংগঠনের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন।

সালেহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হামাসের একজন বিচক্ষণ নেতার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

পশ্চিম তীরে হামাসের নেটওয়ার্ক ও প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সালেহ। তিনি ফিলিস্তিনের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ফাতাহর সঙ্গে হামাসের যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছিলেন। উল্লেখ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে এই দলের (ফাতাহ) প্রাধান্য রয়েছে।

দক্ষতাগুণে হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাঠামোয় পদোন্নতি পেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন সালেহ। তিনি হামাসের শক্তিশালী ‘পলিটব্যুরোর’ সদস্য।

২০১৭ সালে সালেহ হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর উপপ্রধান নির্বাচিত হন। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ইসমাইল হানিয়া।

হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর উপপ্রধান হওয়ার পর সালেহর ভূমিকা আরও বেড়ে যায়। তিনি হামাসের উচ্চপর্যায়ের একজন গুপ্তদূত হিসেবে কাজ করছিলেন। হামাসের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। তিনি হামাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্রও ছিলেন। তবে সালেহ তাঁর কট্টরবাদী পরিচিতিও বজায় রেখেছিলেন।

পশ্চিম তীরে হামাসের সামরিক অভিযানে অর্থায়নসহ তা পরিচালনার জন্য ২০১৫ সালে সালেহকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বা অর্থ দপ্তর। বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা, ছিনতাই ও অপহরণের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক সন্ত্রাসীর তালিকায় সালেহর নাম তোলে। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য তথ্য চেয়ে তারা পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করে।

৭ অক্টোবরের হামলার পরপরই হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর সঙ্গে দেখা করেন সালেহ। ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধে ‘প্রকৃত বিজয় অর্জনের কৌশল’ নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা। পরে বৈঠকটির ছবি প্রচার করা হয়।

পাল্টা হিসেবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। একপর্যায়ে কাতারের মধ্যস্থতায় কয়েক দিনের যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, হামাস কিছুসংখ্যক জিম্মিকে মুক্তি দেয়। বিনিময়ে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতির এই আলোচনায় সালেহর ভূমিকা ছিল।

ইসরায়েলের বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, উভয় পক্ষের ব্যক্তিদের মুক্তির তালিকা তৈরিতে সালেহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁর এই ভূমিকাকে ‘অপরিহার্য’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বারবার ইঙ্গিত দিয়ে এসেছেন যে হামাস নেতারা তাঁদের নিশানায় আছেন।

গত নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, তিনি ইসরায়েলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে হামাসের সব নেতা, তাঁরা যে যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁদের হত্যা করতে হবে।

গত ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের প্রধানের একটি রেকর্ডিং ফাঁস হয়। এতে তিনি ইসরায়েলি পার্লামেন্টের সদস্যদের বলেন, গাজা, পশ্চিম তীর, লেবানন, তুরস্ক, কাতার—সর্বত্র হামাস নেতাদের হত্যা করা হবে।

১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি দলের ওপর একটি সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামলা চালায়। এই হামলার জেরে গুপ্তহত্যা মিশন শুরু করেছিল ইসরায়েল। এর সঙ্গে ইসরায়েলের বর্তমান গুপ্তহত্যা মিশনের তুলনা করা হচ্ছে। সেই প্রচেষ্টার মতো এই মিশনও (গুপ্তহত্যা) ইসরায়েলিদের আশ্বস্ত করতে পারে।

৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়ে আগে জানতে না পারার মতো অত্যন্ত গুরুতর গোয়েন্দা ব্যর্থতার জেরে ইসরায়েলের বর্তমান সরকার তীব্র সমালোচনা ও প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। নেতানিয়াহুর নেওয়া গুপ্তহত্যার মিশন তাঁর সরকারের প্রতি জনসমর্থন জোরদার করতে পারে।

তবে উদ্বেগও আছে। কেননা, এই ধরনের কৌশল ইসরায়েলের জন্য বুমেরাং হতে পারে।

ইসরায়েলের আগের গুপ্তহত্যার নিশানা থাকা কেউ কেউ গার্ডিয়ানকে বলেছেন, তাঁরা নিবৃত্ত হননি, বরং তাঁরা আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন।

অন্যরা বলছেন, এই ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যক্তি বা সংগঠনের যেকোনো ক্ষতিই সাময়িক।

বিশ্লেষকেরাও বলেছেন, গুপ্তহত্যার পরিণতি প্রায়ই খুব অপ্রত্যাশিত বা অনিশ্চিত হয়ে থাকে। একজন নেতার মৃত্যু একটি গোষ্ঠীকে তার কৌশল পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে। এমনকি সহিংসতা ত্যাগ করতেও বাধ্য করতে পারে। কিন্তু একইভাবে অন্য কারও উত্থান ঘটাতে পারে, যিনি হয়তো আরও অনমনীয়।

হিজবুল্লাহর প্রধানের আজ বুধবার ভাষণ দেওয়ার কথা। তিনি ইতিমধ্যে অঙ্গীকার করেছেন, লেবাননের মাটিতে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।

সালেহর হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলের যুদ্ধকে দুটি ফ্রন্টে নিয়ে যেতে পারে। সেটি হবে এমন এক দৃশ্য, যা ইসরায়েল আগে এড়াতে চেয়েছিল।