সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক বছরের মধ্যে গত বুধবার সবচেয়ে বড় আক্রমণ পরিচালনা করেছেন বিদ্রোহীরা। এরপর মাত্র তিনদিনে অর্থাৎ শনিবারের মধ্যে তাঁরা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
বিদ্রোহীদের বিস্ময়কর এ আক্রমণের জের ধরে ২০১৬ সালের পর এ প্রথম আলেপ্পোতে বাশার আল–আসাদ সরকারের পক্ষে বিমান হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। আক্রমণের মুখে টিকতে না পারে শহরটি ছেড়ে চলে গেছেন সরকারি সেনারাও।
এদিকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এবার উত্তরের হামা প্রদেশের দিকে এগোচ্ছেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। সিরীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সানা গতকাল রোববার এ খবর জানিয়েছে।
বাশার সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিকতম এ আক্রমণে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইসলামপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়াযুদ্ধে যুক্ত থাকার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তাদের।
আকস্মিক সিরিয়া পরিস্থিতির এমন নাটকীয় মোড়ে প্রেসিডেন্ট বাশার কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
সিরিয়ায় ২০১১ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। কিন্তু সরকার তাতে দমন-পীড়ন চালায়। এতে দেখা দেয় সহিংসতা। পরে তা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এর পর থেকে রক্তক্ষয়ী এ লড়াইয়ে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
এইচটিএস গঠিত হয় ২০১১ সালে ‘জাবহাত আল–নুসরা’—এ ভিন্ন নামে। তখন এটি ছিল আল–কায়েদার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপ।
ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা আবু বকর আল–বাগদাদিও এইচটিএস প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ‘সবচেয়ে কার্যকর ও প্রাণঘাতী’ গোষ্ঠীগুলোর একটি হিসেবে এইচটিএস–কে বিবেচনা করা হয়।
তবে দৃশ্যত এইচটিএসের চালিকাশক্তি হিসেবে রয়েছে যতটা না বিপ্লবী চেতনা, তার চেয়ে বেশি রয়েছে ইসলামি আদর্শ। ‘ফ্রি সিরিয়া’ ব্যানারে সিরিয়ার প্রধান বিদ্রোহী জোটের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় বিরোধ ছিল এইচটিএসের।
২০১৬ সালে এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল–জাওলানি প্রকাশ্যে আল–কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি ‘জাবহাত আল–নুসরা’ বিলুপ্ত করে গঠন করেন নতুন সংগঠন ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ বা এইচটিএস। এক বছর পর আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে একীভূত হয় সংগঠনটি।
সিরিয়ায় ২০১১ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। কিন্তু সরকার তাতে দমন-পীড়ন চালায়। এতে দেখা দেয় সহিংসতা। পরে তা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এর পর থেকে রক্তক্ষয়ী এ লড়াইয়ে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ২০২০ সাল থেকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল আসাদ সরকার। এমনকি এ যুদ্ধ আক্ষরিক অর্থেই শেষ হয়েছে বলে গত চার বছর ধরে মনেও করা হচ্ছিল।
ওই সময়ে সিরিয়ার বড় বড় শহরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে দেশের অপর কিছু অংশ সরাসরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে বাইরে ছিল।
সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা অংশের মধ্যে ছিল পূর্বে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোও। গৃহযুদ্ধ শুরুর পর প্রথমদিকের বছরগুলোতেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে এসব এলাকা কম–বেশি ছিটকে যায়।
দৃশ্যত এইচটিএসের চালিকাশক্তি হিসেবে রয়েছে যতটা না বিপ্লবী চেতনা, তার চেয়ে বেশি রয়েছে ইসলামি আদর্শ। ‘ফ্রি সিরিয়া’ ব্যানারে সিরিয়ার প্রধান বিদ্রোহী জোটের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় বিরোধ ছিল এইচটিএসের।
আসাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে দেশের দক্ষিণে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। এ অঞ্চলে স্বল্প পরিসরে বিদ্রোহী তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও অস্থিরতা ছিল তুলনামূলক কম।
সিরিয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমি এলাকায় আইএসের ঘাঁটি রয়েছে। আইএস এখনো আসাদ সরকারের জন্য হুমকি হয়ে আছে।
অন্যদিকে, দেশের উত্তর–পশ্চিমে ইদলিব প্রদেশে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আলেপ্পোতে এই ইদলিবেরই একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বিস্ময়কর আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নিয়েছে। ইসলামপন্থী এ গোষ্ঠী হলো এইচটিএস।
ইদলিব কয়েক বছর ধরেই একটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে আছে। সিরীয় সরকারি বাহিনী এখানকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট আসাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র রাশিয়া এবং অপর দেশ তুরস্কের মধ্যস্থতায় সরকারি বাহিনী ও তুর্কি–সমর্থিত বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। গত চার বছর ধরে এ চুক্তি অনেকাংশে কার্যকর ছিল।
ইদলিবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বসবাস। চুক্তি সইয়ের আগে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের কাছ থেকে এ প্রদেশের বিভিন্ন শহর–গ্রাম পুনরায় নিজেদের দখলে নেওয়ার পর এই বাসিন্দার অধিকাংশ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন।
সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী—দুপক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর অন্যতম ছিল আলেপ্পোও। গৃহযুদ্ধ চলাকালে আসাদ সেনাদের হামলায় বিদ্রোহীরা যেসব শহরে বড় ধরনের পরাজয়ের মুখে পড়েছিলেন, এটি সেসবের একটি। বিদ্রোহীদের দমনে আসাদ সরকার রুশ বিমান বাহিনী ও ইরানের সেনাবাহিনী, বিশেষ করে তেহরান–সমর্থিত মিলিশিয়াদের সহায়তা নিয়েছিল।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ইরান–সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহও।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্প্রতি লেবাননে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে ও সিরিয়ায় ইরানি সামরিক কমান্ডারদের ওপর ইসরায়েলের হামলা হিজবুল্লাহর জন্য বাধা তৈরি করেছে। কিন্তু ইদলিবের সিরীয় বিদ্রোহীদের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবে আলেপ্পো অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে হিজবুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নিয়ে কম সন্দেহই রয়েছে।
এখন পর্যন্ত ইদলিবকে নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ‘হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)’। কার্যত সেখানকার প্রশাসনও তারাই। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তাদের বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা এখনো সফল হয়নি। আবার, অন্য কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তিক্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব–সংঘাতে জড়িয়েছে তারা।
এখন ইদলিবের বাইরে অন্যান্য অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে এগিয়ে চলার পেছনে এইচটিএসের কী উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেটি স্পষ্ট নয়।
আল–কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার পর এইচটিএসের লক্ষ্য সীমিত হয়ে পড়ে সিরিয়ায় ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে সিরিয়ার সংঘাত নতুন করে উসকে দেওয়ার লক্ষণ সামান্যই রয়েছে।