ইরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইসমাইল হানিয়া ছিলেন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান। দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির সূচনালগ্ন থেকেই এর সদস্য ছিলেন হানিয়া।
হামাস আজ বুধবার হানিয়ার নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে। সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর তেহরানে যে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, সেখানে জায়নবাদীদের হামলায় এ আন্দোলনের প্রধান আমাদের ভাই, নেতা, মুজাহিদ ইসমাইল হানিয়া নিহত হয়েছেন।’
ইসমাইল হানিয়া ১৯৬৩ সালে গাজার আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের ১৫ বছর আগে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ওই সময় হানিয়ার পরিবার গাজা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আশকেলন শহরে পালিয়ে যায়।
তরুণ বয়সে গাজা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাত্র শাখার সদস্য ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। ১৯৮৭ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠালগ্নে সংগঠনটিতে যোগ দেন তিনি। ওই সময় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে ইসলামিক আন্দোলন ইন্তিফাদার প্রথম ধাপ শুরু হয়, যা শেষ হয়েছিল ১৯৯৩ সালে।
প্রথম ইন্তিফাদার সময় হানিয়াকে বেশ কয়েকবার আটক করে কারাদণ্ড দেয় ইসরায়েল। পরে তাঁকে দক্ষিণ লেবাননে ছয় মাসের জন্য নির্বাসনের পাঠানো হয়।
২০০৩ সালে হানিয়া ও হামাসের প্রতিষ্ঠাতা এবং আদর্শিক নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসিনকে একসঙ্গে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তাঁরা যে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, সেখানে বোমা নিক্ষেপ করে একটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। যদিও সেখান থেকে তাঁরা জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন। এর এক বছর পর ইয়াসিনকে হত্যা করা হয়।
২০১৭ সালে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন হানিয়া। তিনি খালিদ মিশালের স্থলাভিষিক্ত হন। অবশ্য এর আগে থেকেই তিনি বহুল পরিচিত মুখ ছিলেন। বিশেষ করে ২০০৬ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর নামডাক বাড়তে থাকে। ওই বছর সংসদ নির্বাচনে বেশির ভাগ আসন পেয়ে জয়ী হয় হামাস। ইসমাইল হানিয়াকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।
কিন্তু খুব দ্রুতই মাহমুদ আব্বাসের দল ফাত্তাহর সঙ্গে হামাসের ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থাপনায় ফাটল ধরে। দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গাজায় ফাত্তাহর কার্যক্রম বন্ধ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়াকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জবাবে ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্টের অনুগতদের সরিয়ে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস।
হামাসের প্রতিপক্ষসহ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন রাজনৈতিক উপদলের প্রধানদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন হানিয়া।
প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাস নেতা হানিয়ার হত্যাকাণ্ডকে কাপুরুষোচিত কাজ ও মারাত্মক উসকানি বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান। মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
অনেক দিন ধরে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন হানিয়া। তিনি তুরস্ক ও কাতারে তাঁর নির্বাসনকাল কাটাচ্ছিলেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার পর হামাসের এক গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, টেলিভিশনে হামাস যোদ্ধাদের অভিযানের চিত্র দেখছেন হানিয়া। এ বিজয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রার্থনা করতেও দেখা যায় তাঁকে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, হামাসের ওই হামলায় ১ হাজার ১৯৭ জন নিহত হন। ওই দিন হামাস যোদ্ধারা ২৫১ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, জিম্মিদের মধ্যে ১১১ জন এখনো বন্দী। ৩৯ জন মারা গেছেন।
এদিকে হামাসের হামলার জবাবে গাজায় তাণ্ডব চালাচ্ছে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা জানান, গত জুনে আল-শাতি এলাকায় হানিয়ার পারিবারিক বাড়িতে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে তাঁর বোনসহ ১০ জন নিহত হন। এ ছাড়া হানিয়ার তিন ছেলে ও চার নাতি-নাতনি গত এপ্রিলে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। ওই সময় হানিয়া বলেছিলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তাঁর পরিবারের ৬০ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।
এ যুদ্ধ গাজার বিস্তৃত অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে মানবিক সংকট। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেশ কিছু কূটনীতিক মিশনে সফর করেন হানিয়া। তিনি গত মঙ্গলবার ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সেখানে পেজেশকিয়ান ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।