আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের পাশ ছাড়ল না যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনের গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘে তোলা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে ওয়াশিংটন। এতে উপত্যকাটিতে রক্তক্ষয় থামানোর প্রয়াস আবার ব্যর্থ হলো।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপে বিশ্বজুড়ে নিন্দা–সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। ওমান বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো মানবিকতার প্রতি ‘লজ্জাজনক অপমান’। এরই মধ্যে গাজায় দফায় দফায় চলছে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা–বোমাবর্ষণ। এতে বাড়ছে হতাহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা আর তাঁদের স্বজনদের আহাজারি।
গাজায় দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি তুলেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি শুরু হতে হতে মধ্যরাত (বাংলাদেশ সময়) পেরিয়ে যায়। ভোটে পরিষদের ১৫ সদস্যদেশের ১৩টিই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। যুক্তরাজ্য ভোট প্রদানে বিরত ছিল। আর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভেটো দেয় পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র।
নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া বা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রয়েছে পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের। এদের কোনো একটি সদস্য চাইলেই যেকোনো প্রস্তাব বাতিল করতে পারে। গাজায় চলমান সংঘাত ঘিরে আগেও পরিষদে আনা চারটি প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছে। তবে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারা প্রয়োগ করায় এবারের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বেশ আলোচনায় ছিল।
গাজায় দুই মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলার মধ্যে যুদ্ধবিরতি ছিল মাত্র সাত দিন। যুদ্ধবিরতি শেষে চলতি মাসের শুরু থেকে আবার হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শনিবারও গাজাজুড়ে হামলা হয়েছে। উপত্যকার নাসের ও আল–আকসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় সেখানে নতুন করে ১৩৩ জনের মরদেহ ও ২৫৯ আহত ব্যক্তিকে আনা হয়েছে। এ নিয়ে ইসরায়েল–হামাস লড়াই শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৭০০ এর বেশি মানুষ।
এদিকে খান ইউনিসের বাসিন্দারা শনিবার জানিয়েছেন, নতুন করে সেখানের আরেক এলাকা থেকে বাসিন্দাদের পশ্চিমে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। জয়নব খলিল নামের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘নিকটেই জালাল সড়ক এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়েছে। এখন (হামলার জন্য) সময়ের অপেক্ষা।’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার ৮০ শতাংশই এখন বাস্তুচ্যুত।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। হামলায় ১ হাজার ১৪৭ জন নিহত হন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত রবার্ট উড বলেছেন, নতুন করে যুদ্ধবিরতি হলে সেদিনের মতো আবারও হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করবে হামাস। তাই নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে ওয়াশিংটন।
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের প্রশংসায় মাতলেও হতাশা প্রকাশ করেছে প্রস্তাব উত্থাপনকারী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর বেইজিং মনে করছে, প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে ‘স্ববিরোধী’ আচরণ করেছে ওয়াশিংটন। গাজায় যুদ্ধবিরতিতে বাধা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘হৃদয়হীন’ বলে আখ্যা দিয়েছে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোকে মানবিকতার প্রতি ‘লজ্জাজনক অপমান’ বলে মন্তব্য করেছে ওমান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোল্লাহিয়ান বলেছেন, গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যত দিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেবে, তত দিন এই অঞ্চলে ‘অনিয়ন্ত্রিত সংঘাত’ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর সমালোচনা করেছে পাকিস্তান, নরওয়ে, মালয়েশিয়া ও ব্রাজিল।
এ নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বেসামরিক মানুষের দুর্দশার প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষ্য, ইসরায়েলকে অস্ত্র ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে যুদ্ধাপরাধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দেশটি।
এদিকে গাজার মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আরব বিশ্বে শুক্রবার প্ল্যাকার্ড ও ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে বিক্ষোভ–সমাবেশ হয়েছে। ওই দিন ফিলিস্তিন ছাড়াও বিক্ষোভ করেন জর্ডান, ইয়েমেন, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ। বিক্ষোভ হওয়ার কথা ছিল বার্লিন, প্যারিস, ব্রাসেলস ও লন্ডনেও।
শুক্রবার রাতভর ও শনিবার দিনের শুরুতে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে সারি ইউসুফ আমর নামে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে আরেক কিশোরও নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২৭৩ জন নিহত হলেন।
শনিবার পশ্চিম তীরে ধরপাকড়ও চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। রামাল্লা, হেবরন ও কালকিলিয়া এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছে। নাবলুসে সড়কে ইসরায়েলের সাঁজোয়া যান চলতে দেখা গেছে। বেথেলহেমে গাড়ি ভাঙচুর করতে দেখা গেছে ইসরায়েলি সেনাদের।