নীরবতা যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। গত ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরের পরপরই লেবাননে ইরান–সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর ওপর ইসরায়েলি বোমা হামলার ২৪ ঘণ্টা পূর্ণ হয়। ওই দিন সকালেই ইসরায়েল নাসরুল্লাহ মৃত বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু হিজবুল্লাহ অনেকটাই নীরব। কিন্তু বৈরুতে হিজবুল্লাহর সদর দপ্তরে হামলা কিংবা নাসরুল্লাহর পরিণতি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করছিল না সংগঠনটি। হিজবুল্লাহর প্রচারমাধ্যমগুলোও বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বেলা আড়াইটার দিকে নাসরুল্লাহর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে হিজবুল্লাহ।
কিন্তু ততক্ষণে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো লেবাননের আকাশে চক্কর দিচ্ছে এবং বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েল দাবি করে, ওই হামলা চালিয়ে তারা হিজবুল্লাহর রকেট, ক্ষেপণাস্ত্রসহ যুদ্ধ সরঞ্জাম ধ্বংস করেছে। ইসরায়েল বলছে, হিজবুল্লাহ আবার সংগঠিত হওয়ার আগে তারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের সব সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দিতে চায়।
নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পরের দিন সকালেই হিজবুল্লাহ ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ১২টির বেশি রকেট নিক্ষেপ করে। কিন্তু তাতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এরই মধ্যে হিজবুল্লাহর ভেতরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কিন্তু হিজবুল্লাহ কীভাবে তার প্রতিশোধ নেবে, তা এখনই ধারণা করা যাচ্ছে না। কারণ, হিজবুল্লাহর বর্তমান নেতারা এখনো ইসরায়েলকে সঠিক জবাব কোনটি হবে, তা নির্ধারণ করতে পারেনি। এরই মধ্যে লেবাননের বৈরুতে ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে কিছু স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি করেছে হিজবুল্লাহ।
হিজবুল্লাহ নেতা নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা এখনই বলা যায়। এ পরিবর্তনের কথা এক বছর আগেও ভাবা যেত না। ইতিমধ্যে এ পরিবর্তন দেখা শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে নাসরুল্লাহ ও হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার বদলা হিসেবে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েল এর কঠিন জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
গত বছর ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলার পর থেকে যে সংঘাত শুরু হয়েছে, তাতে পরদিন থেকেই যোগ দেয় হিজবুল্লাহ। তারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে গাজার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। নাসরুল্লাহ ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো সীমিত সীমান্ত সংঘাতে টিকে যাবেন। কিন্তু তা গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত অলিখিত নিয়ম হিসেবে টিকে ছিল। এর মধ্যে হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ১২ শিশু নিহতের ঘটনা ঘটে। এর জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ইসরায়েল।
এর মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলি অভিযান কমে আসছিল। এ সুযোগকে হাতছাড়া করেননি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তিনি হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধনীতি বদলে ফেলেন। হত্যা করা হয় হিজবুল্লাহর সামরিক প্রধান ফুয়াদ শোকরকে। এ হামলা ছিল ইসরায়েলি বড় হামলার শুরু মাত্র। এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হিজবুল্লাহর যোগাযোগের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া হিজবুল্লাহর বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
নাসরুল্লাহকে হত্যার দুই দিন আগে থেকেই নানা পরিকল্পনা করতে থাকে ইসরায়েল। যখন তারা নিশ্চিত হয়, নাসরুল্লাহ আলোচনা করার জন্য সদর দপ্তরে এসেছেন, তখনই ইসরায়েলি নেতারা হামলার অনুমোদন দেন। এ হামলা তাদের ১৮ বছরের পরিকল্পনার ফসল। এর আগে ২০০৬ সালে তাঁকে একবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
নাসরুল্লাহর সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর সহকারী নাইম কাশেম ও নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য হাশেম সাফিউদ্দিন। এর মধ্যে ৭১ বছর বয়সী কাশেমকে নেতা হিসেবে মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তাই সাফিউদ্দিন সম্ভাব্য প্রার্থী। তিনি কাশেমের চেয়ে কমপক্ষে ১০ বছরের ছোট। তিনি নাসরুল্লাহর চাচাতো ভাই ও ইরানের ঘনিষ্ঠ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিহত ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানির বেয়াই।
এই সাফিউদ্দিনকে হত্যা করতেও হামলা করেছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে একটি ভিডিও বার্তায় বলা হয়েছে, তাঁরা হিজবুল্লাহর সক্ষমতাকে আরও কমিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা হিজবুল্লাহর হাজারো সদস্যকে হত্যা করেছেন। তাঁদের মধ্যে নাসরুল্লাহ আছেন। আছেন তাঁর উত্তরসূরি। এমনকি আছেন এই উত্তরসূরিরও উত্তরসূরি। অনেক বছর ধরে হিজবুল্লাহ যতটা শক্তিশালী ছিল, আজ তার চেয়ে দুর্বল।
হিজবুল্লাহর দায়িত্ব যাঁর কাঁধেই যাক না কেন, তাঁকে হিজবুল্লাহর চার দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে অনিশ্চিত মুহূর্তের মুখোমুখি হতে হবে। দুই মাসের ব্যবধানে ইসরায়েল শুধু হিজবুল্লাহর নেতৃত্বকেই শেষ করে দেয়নি, একই সঙ্গে সংগঠনটির দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও মুছে দিয়েছে। এ ছাড়া লেবাননের জনগণের সামনে হিজবুল্লাহকে অপদস্থ করেছে। লেবাননের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখা হিজবুল্লাহ বড় ধরনের বিপাকে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে হিজবুল্লাহ ইরানের বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে কাজ করেছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের রক্তাক্ত শাসনকে সমর্থন করার জন্য এই গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ ছাড়া ইরান–সমর্থিত ইরাকি ও ইয়েমেনের মিলিশিয়া বাহিনীকে এরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাই নাসরুল্লাহর মৃত্যুতে আরব দেশের কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। তবে উপসাগরীয় দেশগুলো মুখ বন্ধ রেখেছে।
নাসরুল্লাহ ইরানকে যে সেবা দিয়েছে, তার বদলে ইরানের প্রতিক্রিয়া দেখানো স্বাভাবিক। এ ছাড়া ইরানে অতিথি হয়ে যাওয়া হামাস নেতাকে হত্যার বিষয়টিও ইরানকে তাতিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া ইরানি জনগণের সামনে দেশটির নেতাদের মুখ রক্ষার বিষয়টিও রয়েছে। সেখানকার অতি রক্ষণশীলেরা ইরানকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। তবে ইরানের মধ্যেও আশঙ্কা রয়েছে, ইসরায়েলি চর তাদের মধ্যেও রয়েছে।
ইতিমধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলি হামলার হুমকির মুখে পাল্টা হুমকি দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি বলেছেন, ইসরায়েল হামলা চালালে কঠিন জবাব দেওয়া হবে।
দীর্ঘ মেয়াদে কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরান তাদের নিরাপত্তা নীতি ও কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। কাতার, লেবানন ও সিরিয়া সফরের পর সৌদি আরব সফর করেছেন। তিনি সৌদি সফরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক সৌদি আরবের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরানের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করেছে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ইসরায়েলি হামলার জন্য আকাশসীমা ব্যবহার করতে না দেওয়ার অনুরোধ করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ইরানে হামলার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরানে হামলার ব্যাপারে ইসরায়েল অনড়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে হামলার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। তবে ইরান পাল্টা জবাব দেওয়ার বিষয়টি ইসরায়েলি মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে।
এরই মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পুতিন পেজেশকিয়ানকে আশ্বস্ত করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক মস্কোর জন্য বড় অগ্রাধিকার। বৈশ্বিক নানা ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রেও দুই দেশের অবস্থান প্রায় একই রকম।
তেহরান ও মস্কোর ঘনিষ্ঠতা উদ্বেগের চোখে দেখছে হোয়াইট হাউস। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে তারা। তেহরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
তবে ইরানের সবকিছু নির্ভর করছে সেখানকার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির ওপর। খামেনি দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক সক্ষমতার বিষয়টি সামনে আনতে চাননি। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা ইরানকে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাতে উৎসাহী করতে পারে। তবে এ পথে না হাঁটলে তাঁকে নিজের বয়সের দিকেও ফিরে দেখতে হবে। এখন তাঁর বয়স ৮৫। তাই সব সময় তার সিদ্ধান্ত চলবে না, এটাও মাথায় রাখতে হবে।
ইরান একসময় হিজবুল্লাহর ওপর নির্ভর করে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করে এসেছে। কিন্তু এখন হিজবুল্লাহর বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার সেই রক্ষাকবচ ভেঙে পড়তে পারে।
হিজবুল্লাহর ওপর ইসরায়েলি হামলা দেখে আরবের একজন কর্মকর্তা ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সঙ্গে একে তুলনা করেন। ওই সময় হিজবুল্লাহর ক্ষমতা নিয়ে যে ভ্রান্তি ছিল, তা নিমিষেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
মিসরের ক্যারিশম্যাটিক নেতা জামাল আবদেল নাসের নিজের ক্ষমতার একটি গল্পকাহিনি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলি হামলায় তাঁর সে ভুল ভাঙে। ইসরায়েলি হামলায় টিকতে পারেনি তাঁর ক্ষমতা। মিসর আর কখনো তাদের সম্মান উদ্ধার করতে পারেনি।
নাসরুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরেই ইরান–সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিরোধ অক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, হিজবুল্লাহর মধ্যে ঐক্য রয়েছে এবং তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ ধরে হিজবুল্লাহর সদস্যদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে এর জবাব দেওয়ার পর উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তবে কয়েক দিনের লড়াইয়ে এটা স্পষ্ট, হিজবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করা ইসরায়েলের পক্ষ সহজে সম্ভব নয়। কারণ, হিজবুল্লাহর কাছে রয়েছে হাজারো সশস্ত্র সদস্য, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের অস্ত্রাগার এবং জনপ্রিয় সমর্থনের ভিত্তি। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে এ লড়াইয়ের পর সশস্ত্র যোদ্ধাদের যে বাহিনী গড়ে উঠবে, তা আগের হিজবুল্লাহর চেয়ে আলাদা হবে।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, রয়টার্স ও এএফপি