ইসরায়েলি বাহিনী যদি নির্বিচার বোমা হামলা বন্ধ করেও দেয়, এরপরও ফিলিস্তিনের গাজায় প্রাণহানি বাড়তির দিকে থাকতে পারে, এমনটা আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা। বিশ্বখ্যাত জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি চিঠিতে এমন আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। গবেষকদের আশঙ্কা, গাজায় নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৮৬ হাজারে।
টানা ৯ মাসের যুদ্ধ গাজাবাসীর জনস্বাস্থ্যে কেমন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, সেই ধারণা উঠে এসেছে ওই চিঠিতে। সেই সঙ্গে গাজায় নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণের গুরুত্ব এবং সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসুবিধার কথাও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন গবেষকেরা।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ৯ মাস ধরা চলা ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় গাজা উপত্যকায় ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধের সময় এসব পরোক্ষ মৃত্যুর পেছনে অপুষ্টি, ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা না পাওয়া, স্যানিটেশন–ব্যবস্থার সংকটসহ আরও নানা কারণ কাজ করেছে, করছে। কিন্তু নিহত মানুষের তালিকায় এসব কারণ উপেক্ষিত। এসব কারণে যাঁরা মারা গেছেন বা যাচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যাটি নিহত মানুষের তালিকায় যুক্ত করা হয়নি।
নিহত মানুষের এই সংখ্যার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এমনকি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাটির যথার্থতা নিরূপণ করা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের ধারণা, নিহত মানুষের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে তা সম্ভবত বেশ কম। কেননা, গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো হাজার দশেক মানুষের মরদেহ চাপা পড়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। তাঁদের সংখ্যা নিহত মানুষের তালিকায় ধরা হয়নি।
নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা জানা জরুরি। জবাবদিহির জন্য এটা দরকার। এমনকি যুদ্ধের প্রকৃত ক্ষত নিরূপণে, অবকাঠোমো পুনরুদ্ধার ও সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করতে এটা জানা দরকার।রাশা খতিব, যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের অ্যাডভোকেট অরোরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ক্লিনিকাল মহামারি বিশেষজ্ঞ।
গাজায় যদি আজকেই স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তাহলে হয়তো ভাবতে পারেন, আজকে থেকে মৃত্যু থেমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হবে না। কেননা, মানুষ শুধু সরাসরি যুদ্ধেই নিহত হন না। প্রাণ হারানোর আরও অনেক পরোক্ষ কারণ রয়েছে, এমনটাই লিখেছেন গবেষকেরা।
গবেষকদের মতে, যুদ্ধের সময় এসব পরোক্ষ মৃত্যুর পেছনে অপুষ্টি, ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা না পাওয়া, স্যানিটেশন–ব্যবস্থার সংকটসহ আরও নানা কারণ কাজ করেছে, করছে। কিন্তু নিহত মানুষের তালিকায় এসব কারণ উপেক্ষিত। এসব কারণে যাঁরা মারা গেছেন বা যাচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যাটি নিহত মানুষের তালিকায় যুক্ত করা হয়নি।
সরাসরি যুদ্ধে যতজন নিহত হয়েছেন, তার চেয়ে পরোক্ষ কারণে বেশি মানুষের প্রাণ গেছে; এমন উদাহরণও আছে। পূর্ব তিমুরে ১৯৭৪ ও ১৯৯৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার আক্রমণের সময় প্রায় ১৯ হাজার মানুষ নিহত কিংবা নিখোঁজ হন। বিশ্লেষকেরা পূর্ব তিমুরের এমন পরিস্থিতিকে ‘জাতি হত্যা’ বলে দাবি করেন।
কিন্তু একই সময়ে পূর্ব তিমুরে পরোক্ষভাবে প্রাণ হারান প্রায় ৮৪ হাজার মানুষ। অর্থাৎ সরাসরি যুদ্ধে নিহত হওয়া প্রতি একজনের বিপরীতে পরোক্ষ কারণে চারজন মানুষের প্রাণ যায়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া। মানুষ যখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, তখন সেটা শুধু তাঁদের মানসিক পীড়ার কারণ হয়, তা–ই নয়; তাঁদের নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। অনেকেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন।
ল্যানসেটে প্রকাশিত গাজা নিয়ে লেখা চিঠির দুজন সহ–লেখক সেলিম ইউসুফ ও রাশা খতিবের সঙ্গে কথা বলেছেন গার্ডিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যবিষয়ক সম্পাদক মোনা চালাবি।
সেলিম ইউসুফ বলেন, যুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি ভেবেছিলেন, গাজায় সরাসরি যুদ্ধে নিহত হওয়া প্রতি একজনের বিপরীতে পরোক্ষ কারণে চারজন মানুষ মারা যেতে পারেন। তবে এখন তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এই অনুপাত আরও বেশি হতে পারে।
সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউসুফ ও তাঁর সহকর্মীরা বলছেন, একজনের বিপরীতে চারজনের প্রাণ হারানোর তত্ত্ব মেনে নিলেও গাজায় প্রকৃত নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৬ হাজার। গাজা উপত্যকায় মোট জনসংখ্যা ২৪ লাখ। এর অর্থ হলো, চলমান যুদ্ধে গাজার প্রায় ৮ শতাংশ মানুষের প্রাণ যেতে পারে।
রাশা খতিব যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের অ্যাডভোকেট অরোরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ক্লিনিকাল মহামারি বিশেষজ্ঞ। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, গাজা নিয়ে এসব পরিসংখ্যানকে কঠিন ভবিষ্যদ্বাণী নয় বরং অনুমান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘যখন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, যোগাযোগ পরিষেবাও ভেঙে পড়ে তখন নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা তুলনামূলক কম বিশ্বাসযোগ্য হয়। অথচ এ অনুমানের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
একজনের বিপরীতে চারজনের প্রাণ হারানোর তত্ত্ব মেনে নিলেও গাজায় প্রকৃত নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৬ হাজার। গাজা উপত্যকায় মোট জনসংখ্যা ২৪ লাখ। এর অর্থ হলো, চলমান যুদ্ধে গাজার প্রায় ৮ শতাংশ মানুষের প্রাণ যেতে পারে।সেলিম ইউসুফ, কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির পপুলেশন হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক।
গাজার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। যুদ্ধে সেখানে হাসপাতাল, মর্গসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অর্থ হলো, অশনাক্ত মরদেহগুলোকে মৃতদের পূর্বের তালিকায় যুক্ত করতে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাধ্যবাধকতা দেখা দিয়েছে।
রাশা খতিব বলেন, ‘নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা জানা জরুরি। জবাবদিহির জন্য এটা দরকার। এমনকি যুদ্ধের প্রকৃত ক্ষত নিরূপণ, অবকাঠোমো পুনরুদ্ধার ও সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করতে এটা জানা দরকার।’
যুদ্ধ–সংঘাতে পরোক্ষভাবে মানুষ মারা যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর একটি, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি। রাশা খতিব বলেন, যখন সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকবে না, হাসাপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা, চিকিৎসা সরঞ্জাম, স্বাস্থ্য পরীক্ষার গবেষণাগার সক্রিয় থাকবে না; তখন অনেক মানুষ মারা যেতে পারেন। এমনকি বুলেট আর বোমা হামলায় আহত মানুষের পাশাপাশি সন্তানসম্ভবা নারী, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকা ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পূর্ব তিমুরের তুলনায় গাজার স্বাস্থ্য পরিষেবা ও অবকাঠামো বেশ শক্তিশালী। যদিও এবারের ৯ মাসের যুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকেই গাজার স্বাস্থ্য পরিষেবা–ব্যবস্থা চাপের মধ্যে ছিল।
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বেতসেলেম গত বছরের এপ্রিলে এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজা উপত্যকার ওপর ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি অবরোধ চলছে। এতে দীর্ঘদিন ধরেই গাজায় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট রয়েছে।
এ বছরের জুনের মাঝামাঝি এসে যুদ্ধরত গাজায় ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি আংশিকভাবে চালু আছে। বাকিগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। সেখানকার আল–আকসা হাসপাতালের শিশুরোগ–বিশেষজ্ঞ সিমা জিলানি গত ডিসেম্বরে সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে গুরুতর আহত বহু শিশুকে আমি দেখেছি। শিশুদের ওপর হামলা, এতিমদের পুড়িয়ে মারা, আঘাতজনিত অঙ্গচ্ছেদ, এমন অনেক ঘটনা গাজায় ঘটতে দেখেছি। ইরাক কিংবা অন্য কোনো জায়গায় যুদ্ধের সময় এমনটা দেখা যায়নি।’
ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় খামারগুলোও ধ্বংস করে দিয়েছে। একসময় এসব খামারে টকজাতীয় ফল, খেজুর, আঙুর, জলপাই, তরমুজের মতো ফল ফলানো হতো। সেই সঙ্গে গাজাবাসীর জন্য সীমান্তে মানবিক সহায়তা নিয়ে আসা ট্রাক আটকে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
রাশা খতিব বলেন, ‘খাদ্যসংকটের অর্থ হলো, মানুষ এক জায়গা থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। খাবার ও সুপেয় পানির জন্য লম্বা সারিতে দাঁড়াতে হচ্ছে।’
গত ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষুধা নিয়ে সংকটজনক অবস্থায় পড়েছে। দেখা দিয়েছে পানির সংকট। গাজাবাসী সহায়তার আশায় তীব্র শীতের মধ্যে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়েছেন।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া। মানুষ যখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, তখন সেটা শুধু তাঁদের মানসিক পীড়ার কারণ হয়, এমন নয়; তাঁদের নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। অনেকেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন।
শরণার্থী শিবিরগুলোয় মানুষ উপচে পড়ছে। স্যানিটারি–ব্যবস্থা অপ্রতুল। ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রামক রোগ। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে এমনটা দেখা গিয়েছিল। টানা ১১ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। দেশটিতে সরাসরি যুদ্ধে নিহত হওয়া প্রতি একজনের বিপরীতে পরোক্ষ কারণে ১৬ জন মানুষের প্রাণ গিয়েছিল।
চলমান যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই গাজায় অনেক মানুষ উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছিলেন। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য নিযুক্ত জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) গত ডিসেম্বরে জানিয়েছে, এবারের যুদ্ধে গাজায় প্রায় ১৯ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। এটা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। ইসরায়েলি বাহিনীর হুমকির মুখে প্রাণের ভয়ে তাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলকে এড়িয়ে বহির্বিশ্বে যাওয়ার একমাত্র পথ রাফা সীমান্ত ক্রসিং। মিসরের সঙ্গে এই সীমান্ত। গাজার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ কার্যত বিধিনিষেধের আওতায় থাকা রাফায় জড়ো হয়েছেন। যুদ্ধ শুরুর পর রাফায় মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। গাজা উপত্যকার মাত্র ১৭ শতাংশ এলাকায় পুরো গাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন।
এর ফলে গাজায় মানুষের মধ্যে মেনিনজাইটিস, খোসপাচড়া, চুলকানি, জলবসন্তের মতো রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। গত মে মাসে রাফায় হামলা জোরদার করে ইসরায়েলি বাহিনী। এর ফলে গাজার প্রায় অর্ধেক মানুষ নতুন করে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
আশঙ্কা প্রকাশ করে রাশা খতিব বলেন, গাজায় পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যান্য যেকোনো যুদ্ধ ও সংঘাতের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে আর যাঁরা বেঁচে যাবেন, তাঁদের জন্য মানসিক ও শারীরিক পুনরুদ্ধার এবং অবকাঠামোগত পুনর্নির্মাণ, সবই কঠিন হয়ে যেতে পারে।
অনুবাদ করেছেন: অনিন্দ্য সাইমুম