ইসরায়েলি বাহিনীর বোমার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ঘরবাড়ি। তিল ধারণের ঠাঁই নেই আশ্রয়কেন্দ্রে। কোনো স্থানই হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়। এ অবস্থায় যাওয়ার জায়গা না পেয়ে হাজারো ফিলিস্তিনি বেছে নিয়েছেন পরিত্যক্ত একটি কারাগার। খুনি ও দাগি আসামিদের বন্দী রাখার কক্ষগুলোই এখন শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে ঘরবাড়ি হারানো এসব অসহায় মানুষের।
গাজা উপত্যকার দক্ষিণের শহর খান ইউনিস। সেখানকার কেন্দ্রীয় সংশোধন ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে (পরিত্যক্ত) আশ্রয় নিয়েছেন ইয়াসমিন আল দারদাসি ও তাঁর পরিবার। ইসরায়েলি হামলায় ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।
ইয়াসমিন বলেন, ঘর ছেড়ে পালানোর পর তাঁরা এক দিন গাছের নিচে কাটান। পরে পরিত্যক্ত কারাগারটিতে আশ্রয় নেন। এখন সেখানকার প্রার্থনাকক্ষে বাস করছেন। এখানে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, এর চেয়ে বেশি কিছু না।
ইয়াসমিনের স্বামীর একটি কিডনি নষ্ট। ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসও। তাঁদের সঙ্গে নেই কোনো তোশক বা কম্বল। আরও অনেক ফিলিস্তিনির মতো ইয়াসমিনও ভয়ে আছেন, এখান থেকেও তাঁদের উচ্ছেদ করা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানেও স্থায়ী নই।’
ইসরায়েল বলেছে, গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন ইসরায়েলি সেনারা।
আমরা আমাদের সঙ্গে কিছু নিয়ে আসতে পারিনি। শিশুরাও আমাদের সঙ্গে হেঁটে এসেছে। এখানে খাবার পানি খুঁজে পাওয়া খুব দুঃসাধ্য।-সারিয়া আবু মোস্তাফা, কারাগারে সপরিবার আশ্রয় নেওয়া গাজার বাসিন্দা
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। প্রতিশোধ হিসেবে ওই দিন থেকেই গাজায় বিরামহীন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় বারবার ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন গাজার বাসিন্দারা। বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এ উপত্যকার বেশির ভাগ। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরায়েলি বোমা থেকে কোনো স্থানই নিরাপদ নয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ১৩ জুলাই আল-মাওয়াসি এলাকায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এ সময় অন্তত ৯০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। হামাসের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দায়েফকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়।
ইয়াসমিন বলেন, ঘর ছেড়ে পালানোর পর তাঁরা এক দিন গাছের নিচে কাটান। পরে পরিত্যক্ত কারাগারটিতে আশ্রয় নেন। এখন সেখানকার প্রার্থনাকক্ষে বাস করছেন। এখানে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, এর চেয়ে বেশি কিছু না।
গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলায় পূর্ব খান ইউনিসের বিভিন্ন এলাকায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এলাকাটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। লম্বা সময় ধরেই দারিদ্র্য ও বেকারত্বে জর্জরিত এখানকার বাসিন্দারা।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে গাজায় ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই বাস্তুচ্যুত।
সারিয়া আবু মোস্তাফা ও তাঁর পরিবারকে ঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলেছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। হাতে সময় না থাকায় প্রার্থনার কাপড় পরেই বের হয়ে যান তাঁরা। খোলা আকাশের নিচে ধুলাবালুর মধ্যে রাত কাটানোর পর এই পরিবারেরও জায়গা হয়েছে পরিত্যক্ত কারাগারটিতে।
সারিয়া বলেন, ‘আমরা আমাদের সঙ্গে কিছু নিয়ে আসতে পারিনি। শিশুরাও আমাদের সঙ্গে হেঁটে এসেছে। এখানে খাবার পানি খুঁজে পাওয়া খুব দুঃসাধ্য।’
ভাতিজিকে কোলে নিয়ে কথা বলছিলেন সারিয়া। যুদ্ধের মধ্যেই তার জন্ম। ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন শিশুটির বাবা ও ভাই।
ইসরায়েলের তথ্যমতে, ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাস যোদ্ধাদের হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ২৫০ ইসরায়েলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এ পর্যন্ত ৩৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
মিসর, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, তাঁরা গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার খুব কাছাকাছি আছেন। যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ হলে ফিলিস্তিনিরা আরও অনেকবার বাস্তুচ্যুত হতে পারেন।
ছয়বার বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর পরিত্যক্ত ওই কারাগারে আশ্রয় নিয়েছেন হানা আল-সাইয়েদ আবু মুস্তাফা। তিনি বলেন, ‘আমরা কোথায় যাব? সব জায়গাই বিপজ্জনক।’