ইরানে নারীদের হিজার পরা নিশ্চিত করতে আরও কঠোর আইন আনা হচ্ছে। এ আইনের আওতায় নজরদারি বাড়ানো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নজরদারিতে ব্যবহার করা হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এ আইন অমান্য করলে দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটাতে হতে পারে।
হিজাবনীতি ভঙ্গ করার অভিযোগে ইরানে নীতি পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন মাসা আমিনি। পরে পুলিশি হেফাজতে ২২ বছরের এই কুর্দি তরুণী মারা যান। এ মৃত্যু ঘিরে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তুমুল বিক্ষোভ।
বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেওয়া মাসা আমিনির মৃত্যু ও বিক্ষোভ শুরুর প্রথম বর্ষপূর্তির মাস দেড়েক বাকি। এর আগে হিজাব নিয়ে নতুন আইনের বিলের খসড়া নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
খসড়া বিলটির ৭০ ধারায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইরানে যে নারী হিজাব পরতে অস্বীকৃতি জানাবেন, তাঁর সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হবে। আইন ভঙ্গকারী তারকা ও ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে পোশাকনীতি অমান্যকারীদের খুঁজে বের করতে এআই ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে।
আপাতত বিলটি খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এখনো পাস হয়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ বিল ইরানিদের জন্য সরকারের একটি সতর্কবার্তা। সরকার এটাই প্রমাণ করতে চায়, গত বছরের ব্যাপক বিক্ষোভের পরও হিজাবসংক্রান্ত নীতির বিষয়ে সরকার পিছপা হবে না।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ইরানের বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে বিলের খসড়া সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়। পরে তা আইনসভায় পাঠানো হয়। আইনসভার লিগ্যাল অ্যান্ড জুডিশিয়াল কমিশন বিলটি অনুমোদন করে। গত রোববার এ বিল বোর্ড অব গভর্নরে জমা দেওয়া হয়েছে। এরপর বিলটি আইনসভায় পাসের জন্য উত্থাপন করা হবে বলে ১ আগস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম মেহের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে বিলটি ইরানের আইনসভায় পাস হতে পারে। এ বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক বিভাগের পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ইরানে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, সেটার বিরুদ্ধে দেশটির সরকারের বড় প্রতিক্রিয়া এ বিল। এর মধ্য দিয়ে ইরান সরকার নারীদের পর্দা করার রক্ষণশীলতার ওপর জোর দিচ্ছে।
মাসা আমিনির মৃত্যুর জেরে তুমুল বিক্ষোভের মুখে ইরানে নীতি পুলিশের কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে ছিল। তবে ইরান সরকার নীতি পুলিশের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়নি। এ বিষয়ে গত মাসের শুরুর দিকে ইরানি পুলিশের মুখপাত্র সাঈদ মনতাজেরোলমাহদি বলেন, নারীদের পোশাকের বিধান নিয়ে তদারকি কার্যক্রম আবারও শুরু করবে নীতি পুলিশ।
ইরানে হিজাব নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ১৯৩৬ সালে রেজা শাহের শাসনামলে হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। পরে ১৯৪১ সালে তা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হয়। এরপর ১৯৮৩ সাল থেকে ইরানে হিজার পরা বাধ্যতামূলক করা হয়।
ঐতিহ্যগতভাবে ইরানে ইসলামিক দণ্ডবিধির ৩৬৭ ধারাকে হিজাব আইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আইন ভঙ্গ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ দিন থেকে ২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। জরিমানা করা হতে পারে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ ইরানি রিয়াল (বর্তমানে যা ১ দশমিক ১৮ ডলার থেকে ১১ দশমিক ৮২ ডলার)।
খসড়া বিলটিতে হিজাব না পরাকে ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ আইন ভঙ্গের জন্য ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ৩৬ কোটি ইরানি রিয়াল বা ৮ হাজার ৫০৮ ডলার পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে।
ইরানের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের তুলনায় জরিমানার এই অর্থ অনেক বেশি, এমনটাই বলেছেন কানাডার অটোয়ার কার্লটন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী হোসেইন রাইসি।
খসড়া অনুযায়ী, আইনটি বাস্তবায়নে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হবে। হিজাব না পরা নারীদের খুঁজে বের করতে এআইয়ের ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
যদিও ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম চলতি বছরের শুরুতেই জানিয়েছিল, আইন ভঙ্গ করে হিজাব না পরা নারীদের খুঁজে বের করতে সরকারের পক্ষ থেকে জনসমাগমস্থলে ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।