১৯৯০ সালের ২ আগস্ট বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে কুয়েত হামলা শুরু করে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী। ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেশটি তারা দখল করে নেয়। কিন্তু এই দখলদারত্ব সাদ্দাম ও ইরাকের করুণ পরিণতির সূচনা করেছিল।
‘আরব ভাইয়েরা, প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা, দ্রুত আমাদের পাশে দাঁড়ান’—এমন আকুল আবেদন জানানোর পরপরই সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কুয়েত রেডিওর। সেদিন ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট। পারস্য উপসাগরের তেলসমৃদ্ধ ছোট্ট দেশ কুয়েতে তখন চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। এক দিন আগেই ২ আগস্ট দেশটি দখল করতে হামলা চালিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ইরাক।
কুয়েতে এ হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইরাকের তৎকালীন আলোচিত–সমালোচিত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। এর মাত্র বছর দুয়েক আগেই শেষ হয়েছিল ইরাক–ইরান যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে বাগদাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল কুয়েত। সেই সহায়তাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশটির জন্য। সাত মাস ধরে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তাদের।
১৯৯০ সালের ২০ জুলাই থেকেই কুয়েত ঘিরে সেনা মোতায়েন শুরু করেছিল ইরাক। পারস্য উপসাগর ঘিরে তখন তুমুল উত্তেজনা। পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এসেছিল প্রতিবেশী মিসর ও সৌদি আরব। তবে কিছুতেই কাজ হয়নি। ২ আগস্ট বেলা ২টার দিকে বিপুল পরিমাণ সেনা নিয়ে কুয়েতে হামলা শুরু করে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী।
সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ইরাকের অবস্থান তখন ছিল বিশ্বে পঞ্চম। তাদের সামনে কুয়েতের সক্ষমতা ছিল খুবই সামান্য। ইরাকের হামলার শুরুর পর তা মাত্র ১৪ ঘণ্টা পূর্ণ মাত্রায় প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন কুয়েতি সেনারা, তারপর পরাজয়। সহজেই রাজধানী কুয়েত সিটি দখল করে নেয় ইরাক। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান কুয়েতের আমির শেখ জাবির আল–আহমাদ আল–জাবির আল–সাবাহ।
সৌদি আরবে গিয়ে নির্বাসিত সরকার গঠন করে আমির শেখ জাবিরের পরিবার। এই সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় চলে আসেন যুবরাজ সাদ আল–আবদুল্লাহ আল–সালিম আল–সাবাহ। বিদেশে থাকা বেশির ভাগ কুয়েতি সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেন সাবাহ পরিবারের আরেক সদস্য শেখ আলী আল–খলিফাহ আল–সাবাহ। সে সময় এর মূল্য ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার।
আট বছর ধরে চলা ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় বাগদাদকে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার দিয়েছিল কুয়েত।
কুয়েত দখলের পর ৪ আগস্ট দেশটিতে পুতুল সরকার বসান সাদ্দাম হোসেন। নাম দেওয়া হয় ‘কুয়েতিদের মুক্তির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। এরপর ৮ আগস্ট কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে বাগদাদ। এখানেই থেমে থাকেননি সাদ্দাম। লক্ষাধিক সেনা নিয়ে সৌদি আরবের সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তাঁর বাহিনী। এর ফলে সৌদি আরবে হামলার আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে।
সে সময় ইরাকের সেনাবাহিনীর জেনারেল ছিলেন সুবহি তাওফিক। কুয়েতে হামলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আল–জাজিরাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি ছিল উপসাগরীয় দুই দেশের জন্য একটি ভয়ংকর দিন। তবে এদিনের মধ্য দিয়েই ইরাকের ধ্বংসের শুরু হয়েছিল। ওই হামলার পর ইরাকের কোনো কিছুই আর আগের মতো হয়নি।’
ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে কয়েক দশক ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। তবে আশির দশকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় দুই দেশ কাছাকাছি আসে। আট বছর ধরে চলা এ যুদ্ধের সময় বাগদাদকে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার দিয়েছিল কুয়েত সিটি। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের পর ধারের ওই অর্থ শোধ করার কথা ছিল ইরাকের।
তবে যুদ্ধ শেষে ১৯৮৮ সালে ইরাকের অর্থনৈতিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। যুদ্ধের খরচ মেটাতে ধার করা অর্থের পরিমাণও আকাশ ছুঁয়েছে। দেশটির জন্য ওই ধার শোধ করা দূরের কথা, বিদেশ থেকে আরও অর্থ জোগাড় করা জরুরি হয়ে পড়ে। তখনই ইরাক কুয়েতের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে টালবাহানা শুরু করে। তবে কুয়েত সিটি সাফ জানিয়ে দেয়, তাদের অর্থ ফেরত দিতেই হবে।
১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ নামে কুয়েত ও ইরাকে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
ইরাকের অর্থনীতি মূলত তেলনির্ভর। এই তেল বিক্রি করেই ইরানের সঙ্গে যু্দ্ধে ঘিরে নিজেদের ভেঙে পড়া অর্থনীতি চাঙা করতে চাইছিল তারা। এ জন্য বাজারে জ্বালানি তেলের ভালো দাম থাকাটা জরুরি ছিল। তবে ঘটে উল্টোটা। ১৯৯০ সালের জুলাইয়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ১৮ ডলার থেকে কমে ১২ ডলারে দাঁড়ায়।
তেলের দাম পড়ে যাওয়ার জন্য কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে দায়ী করে ইরাক। বাগদাদের দাবি ছিল, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের নির্ধারণ করা সীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করছে কুয়েত সিটি ও আবুধাবি। সে কারণেই দাম কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ইরাক অভিযোগ তোলে যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইরাকের ভূখণ্ডে সামরিক ও জ্বালানি তেলের বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে কুয়েত। এ জন্য দেশটিকে তাদের ঋণ পরিশোধের দাবি থেকে সরে যেতে হবে।
এ নিয়ে আল–জাজিরার সঙ্গে এক আলাপচারিতায় গালফ ইন্টারন্যাশনাল ফোরামের পরিচালক দানিয়া থাফের বলেছিলেন, ‘কুয়েতের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলা হয়, তাহলে দেশটিকে ঘিরে সব সময়ই ইরাকের সম্প্রসারণের নীতি ছিল। দেশটিতে বাগদাদ যে হামলা চালিয়েছিল, তা ওই নীতির সঙ্গে মিলে যায়। আর কুয়েতের অনেকে বলে থাকেন, তাঁদের বিপুল তেলের ভান্ডার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতেই মূলত হামলা চালিয়েছিল ইরাক।’
কুয়েতে ইরাকের হামলার পর এর তীব্র নিন্দা জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইরাক একপ্রকার একঘরে হয়ে পড়ে। হামলার চার দিন পর ৬ আগস্ট কুয়েত থেকে অবিলম্বে ও বিনা শর্তে ইরাকি সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে। একই সঙ্গে বাগদাদের ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
কুয়েত থেকে ইরাক পিছু হটার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ব্যবসাও রমরমা হয়েছিল। যুদ্ধের পর গালফ কো–অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনা শুরু করে।
জাতিসংঘের এ আহ্বান আমলে নেয়নি ইরাক। ১৯৯০ সালের নভেম্বরেও কুয়েতে অবস্থান করছিল সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনী। তখন ১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সেনা না সরালে ‘যেকোনো উপায়ে’ বাগদাদকে বাধ্য করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস হয় নিরাপত্তা পরিষদে।
জাতিসংঘের এই সময়সীমা না মানলে ইরাককে শায়েস্তা করার জন্য তৎপরতা শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। সৌদি আরবে বিপুল পরিমাণ মার্কিন সেনা পাঠান তিনি। সাদ্দাম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটও গড়ে তোলেন।
তবে সাদ্দাম হোসেন একগুঁয়েমি করে ১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারিতেও কুয়েতে সেনা মোতায়েন করে রাখেন। এর এক দিন পরই ১৭ জানুয়ারি ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ নামে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী। কুয়েত ও ইরাকের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক বোমা হামলা চালানো হয়। ৪৩ দিন ধরে চলে এই অভিযান। শেষ ১০০ ঘণ্টা ধরে চালানো হয় স্থল হামলা। শেষ পর্যন্ত ২৭ ফেব্রুয়ারি কুয়েত থেকে পিছু হটে ইরাকি বাহিনী।
ইরাক পিছু হটার পর অল্প সময়ের মধ্যেই সাবাহ পরিবার কুয়েতে ফিরে আসে। বিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে সাজাতে মনোযোগ দেয় তারা। তবে অনেকেই বলেন, ইরাকের হামলার পর কুয়েত আর কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। আর দেশটির অনেক নাগরিকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান ও হামলার সময় হর্তাকর্তা যাঁরা দেশ ছেড়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়।
কুয়েতে হামলা চালানোর জন্য ইরাককেও কম খেসারত দিতে হয়নি। বলা চলে, ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞের পথ খুলে দিয়েছিল ওই হামলা। ২০০৩ সালে সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধেই ইরাকে আবার হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এতে দেশটি তছনছ হয়ে যায়। এরপর আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশটির বড় অংশ দখল করে রেখেছিল তারা।
কুয়েতে হামলার মধ্য দিয়ে বাগদাদ চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিজেদের আরও বড় শক্তি হিসেবে জানান দিতে। কুয়েতের তেলসম্পদও দখল করতে চেয়েছিল। তবে সেগুলোর কোনোটি সফলতার মুখ তো দেখেইনি, বরং যুদ্ধকামী দেশ হিসেবে বাগদাদের অবস্থান আরও পোক্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরাকের অবস্থান এখনো তলানিতে।
সে সময় ইরাকের মানুষ কতটা দুরবস্থার মধ্যে ছিল, তা বোঝা যায় দেশটির অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সুবহি তাওফিকের কথা থেকে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় একঘরে হয়ে পড়া ইরাকে তখন তিনি মাসে যে বেতন পেতেন, তা দিয়ে নাকি এক প্যাকেট সিগারেটও কিনতে পারতেন না। তাওফিকের মতে, ইরান যুদ্ধের পর ইরাক যত না সংকটে ছিল, কুয়েতে হামলার পর তা আরও ঘনীভূত হয়।
ইরাক কুয়েতে হামলার পর সৌদি আরবসহ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশের আহ্বানে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ অঞ্চল ঘিরে ওয়াশিংটনেরও নিজস্ব কিছু স্বার্থ ছিল। প্রেসিডেন্ট বুশ চাচ্ছিলেন, এই সুযোগে উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি গেড়ে পরাশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করতে। আর সৌদি আরবসহ আশপাশের দেশগুলোতে ইরাক হামলা চালালে সেখানে তেল উত্তোলনে বাধা আসত। এতে আখেরে ক্ষতি হতো যুক্তরাষ্ট্রেরও।
কুয়েত থেকে ইরাক পিছু হটার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ব্যবসাও রমরমা হয়েছিল। যুদ্ধের পর গালফ কো–অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনা শুরু করে। এ ছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে মার্কিন বাহিনী। মোদ্দাকথা, ইরাক–কুয়েত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্তপোক্ত আস্তানা গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে আইএসের বিরুদ্ধে লড়তে এই ইরাককেই কিন্তু আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশ সহায়তা করেছিল। তাদের হাত ধরেই ২০১৭ সালে দেশটিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির পতন হয়। আইএসের পতনের পর বাগদাদের নড়বড়ে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবেশী দেশগুলোও। মজার বিষয় হলো, যে কুয়েতকে ইরাক ধার করা অর্থ ফেরত দিতে চায়নি, সেই দেশটিই ২০১৮ সালে সহায়তা বাবদ বাগদাদকে তিন হাজার কোটি ডলার দিয়েছিল।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা, হিস্টোরি চ্যানেল, জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট