সিরিয়া যেন সবার স্বার্থের রণক্ষেত্র

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আরব বসন্তের ঢেউ তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। গণতন্ত্রের দাবিতে শুরুতে সিরিয়ায় ছোটখাটো বিক্ষোভ হয়। দ্রুতই এই বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে নৃশংস পথ বেছে নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ। এতে এক দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের চক্করে পড়ে যায় সিরিয়া। এই যুদ্ধের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল ১৫ মার্চ। সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না।

গণতন্ত্র-মুক্তি-সমৃদ্ধির আশায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরের শেষ ভাগে তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের সূচনা হয়। তারপর তা সংক্রমিত হয় লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ২০১১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে সিরিয়ায় প্রথম বিক্ষোভ দেখা দেয়। তবে তা ছিল ছোট, বিচ্ছিন্ন। সিরিয়াজুড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায় ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। এই দিনটিকেই সিরিয়ায় গণ-আন্দোলনের শুরুর দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ তাঁর গদি টিকিয়ে রাখতে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে থাকেন। অবস্থা বেগতিক দেখে একপর্যায়ে তিনি তাঁর সশস্ত্র বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। সিরিয়ায় আরব বসন্তের বিক্ষোভ রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়। সংঘাত থেকে গৃহযুদ্ধ।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ পরে অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে। দেশি-বিদেশি নানা পক্ষের রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সিরিয়া। এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে ইরান, ইসরায়েল, লেবানন, তুরস্ক, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের মতো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি। এই যুদ্ধে সবাই সবার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধের দামামায় মাঝে হারিয়ে যায় সিরীয় জনগণ।

বাশার আল–আসাদ এখনো টিকে আছেন। আর সিরীয় জনগণ, যারা এক দশক আগে একনায়কতন্ত্র-স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় রাজপথে নেমেছিল, তারা এখন গণতন্ত্র চাওয়ার মূল্য দিচ্ছে। তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বিভীষিকায় রূপ নিয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার চাওয়ার জন্য সিরীয়দের যে অবর্ণনীয় পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে, তা বর্তমান শতকে বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা ইরাক ও সিরিয়ার একটা বড় অংশ দখল করে ২০১৪ সালের জুনে কথিত ‘খেলাফত’ ঘোষণা করে। আইএসের কথিত এই খেলাফতের রাজধানী করা হয় সিরিয়ার রাক্কা। আইএস বর্বরতা-নৃশংসতা দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের কেন্দ্রে চলে আসে। সারা বিশ্বে তারা ত্রাস সৃষ্টি করে। পরে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পাশাপাশি সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, নানান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অভিযানে ২০১৭ সালে আইএসের কথিত খেলাফতের পতন হয়।

বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র সিরিয়া। সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে ৪ থেকে ৬ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে দুই লাখের বেশি রয়েছে বেসামরিক মানুষ।

গৃহযুদ্ধ-পূর্ব সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই সংখ্যা প্রায় ১২ মিলিয়ন। বাস্তুচ্যুত সিরীয়দের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু রয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় বাস্তুচ্যুতি আর দেখেনি বিশ্ব।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। কারণ, সিরিয়ায় বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সিরীয় শরণার্থীরা তুরস্ক, লেবানন, জর্ডানসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষ নিহত হয়েছে

যুদ্ধে সিরিয়ার শহর-নগর-জনপদ বিধ্বস্ত। যেসব বেসামরিক মানুষ এখনো সিরিয়ায় আছে, তাদের জীবন নানাভাবে বিপন্ন-বিপদগ্রস্ত-ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, সিরিয়ায় এখন যারা অবস্থান করছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে।

গৃহযুদ্ধ দেশটির জীবনব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এএফপি বলছে, সিরিয়ার পাউন্ড এক দশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হারিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতি ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই যুদ্ধ যদি এখনই শেষ হয়, তাহলেও ২০৩৫ সাল নাগাদ তার ক্ষতির মূল্য আরও ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হবে।

যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুটি বিষয় যুক্ত করলে সিরীয় যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। শুধু, তা-ই নয়, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের আয়ুষ্কাল ১৩ বছর কমেছে।

সিরিয়ায় ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মানবতার জন্য এক লজ্জার দশক হিসেবে অভিহিত করেছেন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (এনআরসি) মহাসচিব জ্যান এজল্যান্ড।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত নেই। দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ আগেই স্পষ্ট করেছেন যে তিনি তাঁর ক্ষমতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে রাজি নন। বরং তিনি ২০১১ সালের মার্চের আগের অবস্থায় ফিরতে চান।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সিরিয়ায় শান্তি ফেরানোর ব্যাপারে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সিরিয়ায় হত্যাযজ্ঞ-ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে তাদের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। উপরন্তু, জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন একটি আলোচনা গত জানুয়ারিতে জেনেভায় ভেস্তে যায়।

সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ-অচলাবস্থার ব্যাপারে পশ্চিমা নির্ধারক শক্তিগুলো আগ্রহ হারিয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক সিমন টিসডিল। এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে তাকে একটি ‘সীমাহীন যুদ্ধ’ (এন্ডলেস ওয়ার) বলে অভিহিত করেছেন উইন উইদাউট ওয়ার সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর স্টিফেন মাইলস।