সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দারা শহর তিন বছর আগেই দেশটির সরকারি বাহিনীর দখলে চলে যায়। সম্প্রতি দারায় তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে। বিরোধীরা আবারও শক্তি সঞ্চয় করেছে। সরকারি বাহিনীও সেখানে অভিযান বাড়িয়েছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে জনসাধারণকে। কারণ, সেখানে দুই পক্ষের লড়াইয়ে প্রাণ যাচ্ছে বেসামরিক নাগরিকদের।
দারা শহরের একটি এলাকা দারা-আল-বালাদ। এই এলাকা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে ব্যাপক সংঘর্ষ হচ্ছে। সেখানে বিমান হামলা যেমন চলছে, তেমনি স্থলপথে যুদ্ধও চলছে। এ কারণে সেখানকার অর্ধেক বাসিন্দা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, বাকি অর্ধেক বাসিন্দাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত জেইর পেডারসেন গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, সেখানকার জনসাধারণ খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সংকটে রয়েছে। দারা-আল-বালাদের পরিস্থিতিকে ‘প্রায় অবরুদ্ধ’ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। পেডারসেন বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
দারা শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। জর্ডান সীমান্তবর্তী এবং ইসরায়েলের দখলকৃত গোলান মালভূমির নিকটবর্তী এলাকা এটি। সিরিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত দারা। কারণ, ২০১১ সালে দারা শহরে সিরিয়ার সরকারপ্রধান বাশার আল–আসাদকে নিয়ে একটি গ্রাফিতি আঁকা হয়। এরপর গ্রাফিতি আঁকা ওই কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এতে প্রাণ যায় পাঁচ লাখের বেশি সাধারণ মানুষের। গৃহযুদ্ধের পর দারা শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিদ্রোহীদের হাতে। কিন্তু ২০১৮ সালে আসাদ সরকার আবারও এই শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান করে। সে সময় বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করেছিল।
এ সংকট মিটমাটে কাজ করেছিল রাশিয়ার সরকার। এ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুসারে বিদ্রোহীরা তাঁদের ভারী অস্ত্র জমা দিয়েছিল। সাময়িক শান্তিও এসেছিল। কিন্তু অনেক বিদ্রোহী তা মেনে নেননি। তাঁরা অস্ত্রও জমা দেননি। বিদ্রোহীদের একাংশ অস্ত্র জমা দিয়ে সিরিয়ার বর্তমান সরকারের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। আরেক অংশ বিরত ছিলেন। বিদ্রোহীদের এই অংশ শুধু অস্ত্র জমা না দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন, এমনটা নয়; তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন।
দারা কখনোই পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দারার উত্তরের এলাকা দারা-আল-মাহাত্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর দক্ষিণাঞ্চল দারা-আল-বালাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিদ্রোহীদের।
২০১৮ সালে সরকারি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও দারায় নিয়মিত বিস্ফোরণ হচ্ছে। বিদ্রোহীরা কোনো কোনো এলাকায় ঢুকে হামলা করে পালিয়ে যাচ্ছে। এরপর গত মে মাসে সেখানে একটি ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ওই মাসে সিরিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধীরা এ নির্বাচনের যেমন সমালোচনা করেছেন, তেমনি অনেকেই দারা-আল-বালাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। সত্যিকার অর্থে তাঁরা বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন চেয়েছেন। এ নির্বাচন দেশজুড়ে করাও সম্ভব হয়নি। সরকার নিয়ন্ত্রিত দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় নির্বাচন করা সম্ভব হয়।
দারা-আল-বালাদ এলাকাটি কতটা বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত, তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ নির্বাচনে। সেখানে কোনো কেন্দ্রে নির্বাচন হয়নি। কোনো ব্যালট বাক্স সেখানে পৌঁছায়নি।
কিন্তু আসাদ এই নির্বাচনে জয়লাভের পর শপথ নিয়েছিলেন, তিনি পুরো দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন। ফলে দারা-আল-বালাদ এলাকার বাসিন্দা এবং অধিকারকর্মীদের ধারণা, সরকার সেই প্রতিশোধ নিতে চাইছে। সেখানকার অধিকারকর্মী ওমর আল-হারিরি বলেন, সরকারের তালিকাভুক্ত রয়েছে দারার অনেক মানুষ।
২০১৮ সালে দারায় আসাদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর গত জুলাই মাস ছিল সেখানকার জনসাধারণের জন্য ভয়াবহতম মাস। কারণ, জুলাইয়ের শেষ দিকে সেখানে সংঘর্ষে ৩২ জন প্রাণ হারায়। সিরিয়ার যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, জুলাইয়ে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ জন বেসামরিক নাগরিক।
সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত করতে আবারও আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে রাশিয়া। এর আগেই আল-বালাদের কৃষিজমি দখল করেছে সিরিয়া সরকার। অধিকারকর্মী হারিরির ভাষ্য, এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারপন্থী বাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছে। কিন্তু যাঁদের লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে, সেই বিদ্রোহীদের হাতে রয়েছে মূলত হালকা অস্ত্র।
সিরিয়া জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি সেন্টারের পরিচালক মোহাম্মদ আল-আবদুল্লাহ বলেন, সেখানে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে আসাদ সরকারকে উসকানি দিচ্ছে ইরান।
এর পেছনে ইরানের অবশ্য উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ, গোলান মালভূমি ইসরায়েলের দখলে। সে জন্য দারার বিভিন্ন এলাকায় ইরানপন্থী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
আবার দারা নিয়ে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়া চাইছে সেখানে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর ফিফথ ক্রপসের সদস্যদের মোতায়েন করা হোক। কারণ, এই বাহিনীতে রাশিয়ার প্রভাব রয়েছে। ফিফথ ক্রপসের অনেক সদস্য বিদ্রোহী থেকে আসা। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহর পর্যবেক্ষণ হলো, সিরিয়ার এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ইরান ও রাশিয়ার একধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হারিরির পর্যবেক্ষণ হলো, ভালো কিছু বেছে নেওয়ার সুযোগ আল-বালাদবাসীর নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে দুটি সুযোগ। এর একটি হলো ফিফথ ক্রপস মোতায়েন। এর ফলে রাশিয়া এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ করবে। আর অন্যটি হলো, মাঝেমধ্যেই সরকারি বাহিনীর অতর্কিত হামলা।’
দারার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ। সেখানে লড়াই বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত জেইর পেডারসেন। এ ছাড়া সেখানে ত্রাণসহায়তা নিরবচ্ছিন্ন রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আল-বালাদ এলাকার বাসিন্দা ছিল ৫৫ হাজার। তার মধ্য থেকে প্রায় ২৪ হাজার বাসিন্দা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এই বাসিন্দারা হয় আশপাশের অন্য এলাকায় চলে গেছে, নয়তো সরকারনিয়ন্ত্রিত শহরের অন্য এলাকায় চলে গেছে। সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরে জেইর পেডারসেন বলেন, সেখানে জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। রান্নার জন্য গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। রয়েছে খাবারসংকট। এমনি চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট রয়েছে। এ কারণে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন সরকারি বাহিনী এই আল-বালাদ এলাকা ঘিরে ফেলেছে। এ কারণে ওই শহরে ঢোকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, একটি রাস্তা দিয়ে সেখানে ঢোকা যাচ্ছে। আর এটিরও নিয়ন্ত্রণ সরকারি বাহিনীর কাছে। সিরিয়ার মিডিয়া অ্যাকটিভিস্ট আবু আল-তায়েব বলেন, সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে আল-বালাদ এলাকার বাসিন্দারা। মাঝেমধ্যে শুধু নারী ও শিশুরা বাইরে যেতে পারছেন। আর মাঝেমধ্যে এই পথ পুরোপুরি বন্ধ থাকছে। খাবারের মজুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বাহিনী সেখানকার পানি সরবরাহের লাইন কেটে দিয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।
এএফপি অবলম্বনে মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল